ভারতের পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক (পিএনবি) জালিয়াতি ও অর্থ পাচারের মামলায় অভিযুক্ত ফেরারি হীরা ব্যবসায়ী নীরব মোদীর (Nirav Modi) লন্ডন থেকে ভারতে প্রত্যর্পণের প্রক্রিয়া আরও জটিল হয়ে উঠেছে। প্রায় ছয় বছর ধরে লন্ডনের থেমসাইড কারাগারে বন্দি থাকা ৫৪ বছর বয়সী এই ব্যবসায়ী বৃহস্পতিবার লন্ডন হাইকোর্টে ভিডিও লিঙ্কের মাধ্যমে হাজির হন। এই শুনানিতে তিনি ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার একটি মামলার বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশের আবেদন করেন। ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া তার দুবাই-ভিত্তিক সংস্থা ফায়ারস্টার ডায়মন্ড এফজেডই-এর কাছ থেকে ৮০ লক্ষ মার্কিন ডলারেরও বেশি ঋণ আদায়ের চেষ্টা করছে। তবে, আদালত জানিয়েছে, নীরব মোদীর একটি ‘গোপনীয়’ প্রক্রিয়ার ফলাফল এখনও অমীমাংসিত রয়েছে, যা সম্ভবত ২০২৬ সালের শেষ দিক পর্যন্ত চলতে পারে।
লন্ডন হাইকোর্টের বিচারপতি ডেভিড বেইলি এই শুনানিতে মৌখিক রায় দিতে গিয়ে বলেন, “নীরব মোদী এখনও রিমান্ডে রয়েছেন। তিনি একটি ‘গোপনীয়’ প্রক্রিয়ার ফলাফলের অপেক্ষায় আছেন, যা শীঘ্রই শেষ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।” বিশেষজ্ঞদের মতে, এই গোপনীয় প্রক্রিয়াটি লন্ডনে আশ্রয়ের জন্য নীরব মোদীর আবেদনের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে। তবে, লন্ডনের আদালতে এ বিষয়ে এখনও সরাসরি বা স্পষ্ট কোনো উল্লেখ করা হয়নি, শুধুমাত্র পরোক্ষ ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
নীরব মোদী, যিনি তার নামে প্রতিষ্ঠিত বিলাসবহুল গহনা ব্র্যান্ড ‘নীরব’-এর জন্য পরিচিত, ভারতে তার বিরুদ্ধে ওঠা ফৌজদারি অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি এখনও কোনো অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হননি। শুনানির সময় তিনি ধূসর সোয়েটশার্ট ও জিন্স পরে উপস্থিত হন এবং কারাগারের একটি কক্ষ থেকে টেবিলে থাকা কাগজপত্রের স্তূপ নিয়ে শান্তভাবে নিজের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। তিনি নিজেকে ‘লিটিগ্যান্ট ইন পার্সন’ হিসেবে উপস্থাপন করেন, অর্থাৎ তিনি কোনো আইনজীবীর সাহায্য ছাড়াই নিজের মামলা লড়ছেন।
ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার ঋণ মামলা ও নীরবের দাবি
এই শুনানির মূল বিষয় ছিল ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার দাবি। ব্যাঙ্কটি দুবাই-ভিত্তিক ফায়ারস্টার ডায়মন্ড এফজেডই-এর কাছ থেকে ৮০ লক্ষ মার্কিন ডলারের ঋণ আদায়ের জন্য নীরব মোদীর ব্যক্তিগত গ্যারান্টির ওপর ভিত্তি করে মামলা করেছে। নীরব মোদী এই মামলার শুনানি স্থগিত করার আবেদন জানিয়ে বলেন, কারাগারে থাকার কারণে তিনি ন্যায্য বিচার পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তিনি ইউরোপীয় কনভেনশন অন হিউম্যান রাইটস-এর আর্টিকল ৬-এর উল্লেখ করে দাবি করেন যে, তাকে ন্যায্য বিচারের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না।
নিজের যুক্তি উপস্থাপনের সময় নীরব মোদী বলেন, কারাগারে তার ইন্টারনেট-সংযুক্ত কম্পিউটারে প্রবেশাধিকার নেই। তিনি জানান, শুধুমাত্র ওপেন ইউনিভার্সিটির একটি কোর্স করার সময় তাকে সংক্ষিপ্তভাবে এই সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। তিনি রূপকভাবে বলেন, “ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার কাছে ট্যাঙ্ক ও মেশিনগান রয়েছে, আর আমার কাছে আছে শুধু কাঠের লাঠি।” এর মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, এই আইনি লড়াইয়ে তিনি সম্পূর্ণ অসম শক্তির মুখোমুখি হয়েছেন।
আদালতের পর্যবেক্ষণ ও পরবর্তী পদক্ষেপ
বিচারপতি বেইলি তার রায়ে নীরব মোদীর স্থগিতাদেশের আবেদন খারিজ করে দেন। তবে, তিনি মামলাটি স্থগিত রেখে নীরব মোদীকে কারাগারে একটি কার্যকরী ল্যাপটপের জন্য আবেদন করার সুযোগ দিয়েছেন। এই ল্যাপটপ তাকে তার প্রতিরক্ষা প্রস্তুত করতে এবং অন্যান্য আইনি বিষয়ে কাজ করতে সাহায্য করবে, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে তার দেউলিয়া মামলাও রয়েছে। এছাড়া, আদালত ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার আইনি দলকে নির্দেশ দিয়েছে যে, নীরব মোদীকে সমস্ত প্রয়োজনীয় আইনি নথি হার্ড কপিতে সরবরাহ করতে হবে, যার মধ্যে ‘সিভিল প্রসিডিউরাল রুলস’ বইটিও অন্তর্ভুক্ত।
মামলাটি এখন সেপ্টেম্বর মাসে একটি প্রাক-ট্রায়াল শুনানির জন্য নির্ধারিত হয়েছে এবং পূর্ণ বিচার ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি, নীরব মোদীর বিরুদ্ধে ভারতে তিনটি ফৌজদারি মামলা চলছে—পিএনবি জালিয়াতির সিবিআই মামলা, সেই জালিয়াতির অর্থ পাচারের ইডি মামলা এবং সিবিআই মামলায় প্রমাণ ও সাক্ষীদের সঙ্গে হস্তক্ষেপের অভিযোগ।
প্রত্যর্পণে বিলম্ব: ভারতের উদ্বেগ
নীরব মোদীকে ২০১৯ সালের ১৯ মার্চ লন্ডনে গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং ২০২১ সালের এপ্রিলে তৎকালীন যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিব প্রীতি প্যাটেল তার প্রত্যর্পণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে, এই গোপনীয় প্রক্রিয়ার কারণে তিনি এখনও লন্ডন রয়ে গেছেন। ভারত সরকার বারবার যুক্তরাজ্যের কাছে তার প্রত্যর্পণের জন্য চাপ দিয়ে আসছে। গত নভেম্বরে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমারের সঙ্গে বৈঠকে এই বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন।
ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো (সিবিআই) এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) নীরব মোদীকে ফিরিয়ে আনার জন্য ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে, যুক্তরাজ্যের আইনি প্রক্রিয়া এবং এই গোপনীয় আবেদনের জটিলতার কারণে প্রত্যর্পণে বিলম্ব হচ্ছে।
জনমনে প্রশ্ন
নীরব মোদীর মামলা ভারতের আর্থিক জালিয়াতির ইতিহাসে অন্যতম বড় ঘটনা। পিএনবি কেলেঙ্কারিতে প্রায় ১৪,০০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে অভিযোগ। এই ঘটনা দেশের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার ত্রুটি এবং তদন্তে ধীরগতির প্রশ্ন তুলেছে। নীরব মোদী যদি যুক্তরাজ্যে আশ্রয় পান, তবে ভারতের জন্য তাকে বিচারের মুখোমুখি করা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগছে—এত বড় অপরাধের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও কেন এখনও তিনি ভারতে ফিরে আসেননি?
এই গোপনীয় প্রক্রিয়ার ফলাফল এবং আদালতের পরবর্তী সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে নীরব মোদীর ভবিষ্যৎ। তবে, এটি স্পষ্ট যে, এই আইনি লড়াই শীঘ্রই শেষ হচ্ছে না।