নয়াদিল্লি: জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক কাউন্সিল (NCERT) সম্প্রতি অষ্টম শ্রেণির সমাজবিজ্ঞান বইয়ে মুঘল সম্রাট বাবরকে ‘ক্রূর ও নির্দয়’ শাসক হিসেবে বর্ণনা করায় নতুন করে বিতর্কের মুখে পড়েছে। ‘এক্সপ্লোরিং সোসাইটি: ইন্ডিয়া অ্যান্ড বিয়ন্ড’ শীর্ষক এই পাঠ্যবইটি ২০২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে চালু হয়েছে এবং এখানেই মুঘল শাসনের প্রেক্ষাপটে এমন মন্তব্য উঠে এসেছে (NCERT Mughal History Controversy)। বইটিতে বলা হয়েছে, প্রথম মুঘল সম্রাট বাবর ছিলেন এমন এক শাসক যিনি বহু জনপদের মানুষদের নির্বিচারে হত্যা করেছিলেন। একইসঙ্গে আকবরের শাসনকে ‘নিষ্ঠুরতা ও সহিষ্ণুতার মিশ্রণ’ বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ঔরঙ্গজেব সম্পর্কে লেখা হয়েছে, তিনি বহু মন্দির ও গুরুদ্বার ধ্বংস করেছিলেন।
একটি সতর্কীকরণও দেওয়া হয়েছে
বইটিতে এই বিবরণগুলোর পাশাপাশি একটি সতর্কীকরণও দেওয়া হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, “ইতিহাসের অন্ধকার অধ্যায়গুলি সম্পর্কে তথ্য এখানে দেওয়া হলেও অতীতের ঘটনার জন্য আজকের কাউকে দায়ী করা যায় না।” তবে এই সতর্কীকরণও বিতর্ক প্রশমনে যথেষ্ট হচ্ছে না বলেই মনে করছেন শিক্ষাবিদদের একাংশ। তাঁদের মতে, শিক্ষার্থীদের মনে একপাক্ষিক দৃষ্টিভঙ্গি গেঁথে দেওয়ার প্রবণতা এখান থেকেই শুরু হয়, এবং ইতিহাসচর্চা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে ওঠে।
এই প্রথম নয়, এর আগেও এনসিইআরটি-র ইতিহাসের পাঠ্যক্রম ঘিরে বহুবার বিতর্ক হয়েছে। কিছুদিন আগে দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাস বইতে বলা হয়, সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণাগুলির ভিত্তিতে হরপ্পা সভ্যতার পতনের জন্য বহিরাগত আর্যদের আগমনের তত্ত্ব আর গ্রহণযোগ্য নয়, বরং আর্যদের ‘ভারতের আদিবাসী’ হিসেবেই দেখতে হবে। আবার ষষ্ঠ শ্রেণির বইয়ে বীরসা মুন্ডা সম্পর্কিত অধ্যায়ে ‘হিন্দু’ শব্দটি বাদ দেওয়া নিয়েও বিতর্ক হয়। আগে যেখানে বলা হয়েছিল, বীরসা মুন্ডা মিশনারি ও হিন্দু জমিদারদের বিরোধিতা করতেন, সেখানে বর্তমানে শুধু ‘জমিদার’ শব্দটি রাখা হয়েছে।
রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উদ্দেশ্য
বিশেষজ্ঞ মহলের একাংশের মত, এনসিইআরটি-র পাঠ্যবইয়ে ধারাবাহিক এই ধরনের পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উদ্দেশ্য। তাঁদের বক্তব্য, ভারত বহু ধর্ম ও সংস্কৃতির সমন্বয়ে গঠিত একটি রাষ্ট্র, যেখানে শক-হুন, পাঠান-মুঘলসহ নানা জনগোষ্ঠী মিলেমিশেই সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। অথচ সাম্প্রতিক পাঠ্যবইগুলিতে সেই সম্মিলনের ইতিহাসকে চাপা দিয়ে, বিভাজনমুখী একটি বয়ান প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে। প্রশ্ন উঠছে, ইতিহাসের প্রেক্ষিতকে এইভাবে পুনর্লিখনের মাধ্যমে কি সত্যিই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে ঐতিহাসিক বাস্তবতা পৌঁছাবে? নাকি, তাদের মনে একরৈখিক ও পক্ষপাতদুষ্ট ধারণাই তৈরি হবে?
এনসিইআরটি-র পক্ষ থেকে এ বিষয়ে এখনও কোনও আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে শিক্ষামহলের একাংশ মনে করছেন, এই পাঠ্যবই বিতর্ক ভবিষ্যতে আরও বিস্তৃত আকার নিতে পারে, এবং কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতির নিরপেক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দেবে।