ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার প্রেক্ষিতে আজ, বুধবার ভারত জুড়ে ২৪৪টি সিভিল ডিফেন্স জেলায় একটি ব্যাপক নাগরিক প্রতিরক্ষা মক ড্রিল (Nationwide Mock Drill) অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই মক ড্রিলটি ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর প্রথম এই ধরনের বড় আকারের প্রস্তুতি। গত ২২ এপ্রিল জম্মু ও কাশ্মীরের পাহালগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর উত্তেজনা তীব্র হয়েছে। এই ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই প্রেক্ষাপটে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে শহরগুলি এয়ার রেইড সাইরেন, ব্ল্যাকআউট, স্থানান্তর পরিকল্পনা এবং বিশেষ টহল ইউনিট স্থাপনের মাধ্যমে প্রস্তুতি নিচ্ছে। নিম্নে বিভিন্ন শহরের প্রস্তুতির বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হল।
দিল্লিতে বিশেষ টহল ইউনিট
দিল্লি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অশীষ সুদ জানিয়েছেন, আজকের মক ড্রিলের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে। পুলিশ বিভিন্ন এলাকায় দিন-রাত টহল জোরদার করেছে, বিশেষ করে পর্যটন এবং বাজার এলাকাগুলিতে। কনট প্লেস, ইন্ডিয়া গেট, জনপথ, যশোবন্ত প্লেস, গোল মার্কেট এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলিতে বিশেষ টহল ইউনিট মোতায়েন করা হয়েছে। সুদ বলেন, “প্রস্তুতি চলছে। আমরা আরও তথ্য সংগ্রহ করব এবং সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি সম্পন্ন করব।” এই ড্রিলে এয়ার রেইড সাইরেন পরীক্ষা, ব্ল্যাকআউট প্রয়োগ এবং জনগণকে জরুরি পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা প্রোটোকল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। দিল্লির মতো ঘনবসতিপূর্ণ এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহরে এই প্রস্তুতি জনগণের মধ্যে আতঙ্ক কমাতে এবং সংগঠিত প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।
মুম্বাইয়ে উপকূলীয় এলাকায় মক ড্রিল (Mock Drill)
মহারাষ্ট্রের নাগরিক প্রতিরক্ষা বিভাগের পরিচালক প্রভাত কুমার জানিয়েছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুযায়ী মুম্বাইয়ের উপকূলীয় এলাকাগুলিতে মক ড্রিল অনুষ্ঠিত হবে। তিনি বলেন, “২০১০ সাল পর্যন্ত নাগরিক প্রতিরক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধকালীন স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ, কিন্তু ২০১০ সালের পর এতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আগামীকাল আমরা উপকূলীয় এলাকায় মক ড্রিল করব। জেলা প্রশাসনের অধীনস্থ সকল সংস্থা এতে অংশ নেবে।” মুম্বাই, থানে, পুণে এবং উরানের মতো উপকূলীয় এলাকাগুলিতে ড্রিলের সময় এয়ার রেইড সাইরেন, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ছদ্মবেশ এবং স্থানান্তর পরিকল্পনার রিহার্সাল অনুষ্ঠিত হবে। মুম্বাইয়ের ঘনবসতি এবং সমুদ্র সীমান্তের কারণে এই ড্রিলে অগ্নিনির্বাপণ, উদ্ধার কার্যক্রম এবং জরুরি প্রতিক্রিয়া সমন্বয়ের উপর বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে।
লখনউতে পুলিশ লাইনে রিহার্সাল
উত্তর প্রদেশের রাজধানী লখনউতে পুলিশ লাইন এলাকায় নাগরিক প্রতিরক্ষা বিভাগ ইতিমধ্যেই মক ড্রিলের রিহার্সাল সম্পন্ন করেছে। পাহালগাম হামলার পর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের অবনতির প্রেক্ষিতে এই প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। পুলিশ এবং স্থানীয় প্রশাসন এই রিহার্সালে অংশ নিয়েছে, যেখানে এয়ার রেইড সাইরেন পরীক্ষা, জনগণকে মাটিতে শুয়ে কান ঢাকার প্রশিক্ষণ এবং উদ্ধার পর্বের সংকেত দেওয়া হয়েছে। একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “আগামীকাল দেশব্যাপী মক ড্রিল অনুষ্ঠিত হবে। নাগরিক প্রতিরক্ষা, পুলিশ এবং স্থানীয় প্রশাসন সমন্বিতভাবে কাজ করছে।” লখনউয়ের ১৯টি জেলা সংবেদনশীলতার ভিত্তিতে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে, এবং এই ড্রিলে ছাত্র, এনসিসি ক্যাডেট এবং হোম গার্ডদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
ভুবনেশ্বরে প্রস্তুতি পর্যালোচনা
ওড়িশার অতিরিক্ত মুখ্য সচিব (স্বরাষ্ট্র) সত্যব্রত সাহু মঙ্গলবার ভুবনেশ্বরে স্বরাষ্ট্র বিভাগে একটি পর্যালোচনা সভার সভাপতিত্ব করেন। এই সভায় নাগরিক প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করা হয়, যেখানে ব্ল্যাকআউট ব্যবস্থা, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ছদ্মবেশ এবং স্থানান্তর পরিকল্পনার রিহার্সালের বিষয়ে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ওড়িশার তালচের, বালাসোর, কোরাপুট, ভুবনেশ্বর, গোপালপুর, হিরাকুদ, পারাদীপ এবং রাউরকেলার মতো এলাকাগুলি এই ড্রিলে অংশ নেবে। রাজ্যের সমুদ্র সীমান্ত এবং শিল্পাঞ্চলের কারণে এই ড্রিলে জরুরি প্রতিক্রিয়া এবং সমন্বয়ের উপর বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে।
পাঞ্জাবের ২০টি জেলায় মক ড্রিল
পাঞ্জাবের মন্ত্রী হরপাল সিং চিমা জানিয়েছেন, রাজ্যের ২০টি জেলায় মক ড্রিল অনুষ্ঠিত হবে। এই ড্রিলে নাগরিক প্রতিরক্ষা, পাঞ্জাব পুলিশ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দলগুলি অংশ নেবে। চিমা বলেন, “আমাদের ৫০০ কিলোমিটার সীমান্ত এবং নাগরিকদের রক্ষা করতে হবে।” পাঞ্জাবের আমৃতসর, ভাটিন্ডা, ফিরোজপুর, গুরুদাসপুর, হোশিয়ারপুর, জলন্ধর, লুধিয়ানা, পটিয়ালা এবং পাঠানকোটের মতো জেলাগুলি এই ড্রিলে অংশ নেবে। রাজ্যটি পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্তবর্তী হওয়ায় এই ড্রিলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং জরুরি প্রতিক্রিয়ার উপর বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে। গত রবিবার ফিরোজপুর ক্যান্টনমেন্টে ৩০ মিনিটের ব্ল্যাকআউট ড্রিল পরিচালিত হয়েছিল, যা সন্ধ্যা ৯:০০ থেকে ৯:৩০ পর্যন্ত চলে।
মক ড্রিলের উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব
মক ড্রিলটি নাগরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রস্তুতি পরীক্ষা করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে এয়ার রেইড সাইরেনের কার্যকারিতা পরীক্ষা, ভারতীয় বিমান বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ লিঙ্ক, কন্ট্রোল রুম এবং শ্যাডো কন্ট্রোল রুমের কার্যকারিতা, স্থানান্তর পরিকল্পনার রিহার্সাল এবং জনগণকে প্রশিক্ষণ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুযায়ী, জনগণকে মেডিকেল কিট, টর্চ, মোমবাতি এবং জরুরি নগদ অর্থ প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে, কারণ ব্ল্যাকআউটের সময় ইলেকট্রনিক লেনদেন ব্যর্থ হতে পারে।
এই ড্রিলটি কোনও আসন্ন সংঘাতের ইঙ্গিত নয়, বরং জরুরি পরিস্থিতিতে জনগণ এবং কর্তৃপক্ষের প্রস্তুতি নিশ্চিত করার একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। স্বরাষ্ট্র সচিব গোবিন্দ মোহনের নেতৃত্বে মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকে প্রস্তুতি পর্যালোচনা করা হয়েছে, যেখানে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ (এনডিএমএ) এবং অন্যান্য সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।