জুবিন গার্গের মৃত্যুর রহস্য ঘনীভূত: সিবিআই তদন্তের দাবি বঙ্গো ভাষী মহাসভার

Zubeen Garg autopsy report

গুয়াহাটি: অসমের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী, গীতিকার ও সংস্কৃতিক প্রতীক জুবিন গার্গের (Zubin Garg) মৃত্যুকে ঘিরে প্রশ্ন ও ক্ষোভ ক্রমশ বেড়ে চলেছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষের কাছে তিনি ছিলেন শুধু এক জন শিল্পী নন—তিনি ছিলেন চেতনার, প্রতিবাদের এবং সত্যের প্রতীক। তাঁর হঠাৎ ও রহস্যজনক মৃত্যু এখন সমগ্র অসমবাসীর মনে জাগিয়েছে গভীর সন্দেহ ও উদ্বেগ। এই প্রেক্ষিতে বঙ্গো ভাষী মহাসভা ফাউন্ডেশন (BBMF) ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উদ্দেশে একটি আনুষ্ঠানিক আবেদনপত্র পাঠিয়ে সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়েছে।

Advertisements

ফাউন্ডেশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট নৃপেন্দ্র কৃষ্ণ রায় পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর থেকে চিঠিটি প্রেরণ করেছেন। চিঠির অনুলিপি পাঠানো হয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারপারসনের কাছেও। সংগঠনের গুয়াহাটি আহ্বায়ক শান্তনু মুখার্জী এই আবেদনকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন করেছেন।

   

চিঠিতে গভীর শোক ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, জুবিন গার্গ কেবল সংগীতের নক্ষত্র ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক নির্ভীক কণ্ঠস্বর—যিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে কখনও দ্বিধা করেননি। তাঁর সংগীত ছিল সমাজের প্রতিচ্ছবি, আর তাঁর কণ্ঠে ফুটে উঠেছিল প্রতিবাদের সুর ও মানবিকতার আবেদন। তিনি ছিলেন অসমের আত্মার প্রতিধ্বনি, উত্তর-পূর্ব ভারতের সাংস্কৃতিক বিবেক।

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে— “জুবিন গার্গ শুধুমাত্র একজন গায়ক নন, তিনি ছিলেন এক সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রতীক। তাঁর সংগীত ও চিন্তাধারা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে সত্য ও ন্যায়ের পথে অনুপ্রাণিত করেছে। যে মানুষ জীবদ্দশায় সত্যের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুকে ঘিরে অস্পষ্টতা মেনে নেওয়া যায় না। সত্যকে আড়াল করা মানে জাতির বিবেককে অপমান করা।”

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মৃত্যুর দিন থেকে আজ পর্যন্ত নানা অসঙ্গতি ও গুজব তৈরি হয়েছে, যা সাধারণ মানুষের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। মৃত্যুর পর এত দিন পেরিয়েও এখনো পর্যন্ত পোস্টমর্টেম রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি। চিঠিতে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, “যদি ইতিমধ্যে কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়ে থাকে, তবে পুলিশের হাতে নিশ্চয়ই কিছু প্রাথমিক প্রমাণ রয়েছে। সেই প্রমাণ ও তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা হচ্ছে না কেন?”

সংগঠনটির দাবি, এমন এক শিল্পীর মৃত্যু ঘিরে অনিশ্চয়তা থাকা জাতীয় লজ্জা। তাই অবিলম্বে সিবিআই তদন্ত শুরু করা প্রয়োজন, যাতে সত্য সামনে আসে এবং কোনও দোষী ব্যক্তি বিচার এড়িয়ে যেতে না পারে। সংগঠনটি মনে করে, “ন্যায় যদি বিলম্বিত হয়, তবে তা ন্যায়েরই অস্বীকার।”

চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, এই মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন সিদ্ধার্থ শর্মা, শ্যামকানু মহন্ত, অমৃত প্রভা মহন্ত, শেখর জ্যোতি গোস্বামী এবং সন্দীপন গড়। জনগণের মনে প্রশ্ন, তাদের গ্রেফতারের পেছনে কী প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে, তদন্ত কোন পর্যায়ে রয়েছে এবং সরকার এই বিষয়ে কী অবস্থান নিয়েছে—এই সমস্ত বিষয়ে জনসাধারণের স্পষ্ট ধারণা প্রয়োজন।

বঙ্গো ভাষী মহাসভা ফাউন্ডেশনের সভাপতি নৃপেন্দ্র কৃষ্ণ রায় বলেন, “জুবিন গার্গ শুধুমাত্র একজন সংগীতশিল্পী ছিলেন না, তিনি ছিলেন অসমের চেতনার প্রতীক। তাঁর মৃত্যু নিয়ে যে প্রশ্ন উঠছে, তা গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতের সংস্কৃতিমনস্ক মানুষকে গভীরভাবে ব্যথিত করেছে। আমরা শুধু একজন শিল্পীর জন্য ন্যায় চাই না, আমরা চাই সত্যের প্রতিষ্ঠা।”

Advertisements

সংগঠনের গুয়াহাটি আহ্বায়ক শান্তনু মুখার্জী বলেন, “অসমের প্রতিটি মানুষ জানে, জুবিন গার্গ কেমন নির্ভীকভাবে সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। আজ তাঁর মৃত্যুর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা মানে সেই মূল্যবোধের প্রতিই শ্রদ্ধা জানানো। আমরা আশা করি, প্রধানমন্ত্রী দ্রুত সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেবেন। জনগণের একটাই চাওয়া—সত্য প্রকাশ পাক, ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হোক।”

চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, জুবিন গার্গের অবদান কেবল সংগীতে নয়, সমাজে। তিনি ছিলেন ঐক্যের দূত, যিনি সংগীতের মাধ্যমে ভাষা, ধর্ম ও প্রদেশের সীমা অতিক্রম করেছিলেন। তাঁর গানে প্রতিফলিত হয়েছে ভারতবর্ষের ঐক্যবদ্ধ চেতনা। সংগঠনটি জানিয়েছে, “যে মানুষ জীবনের প্রতিটি পর্বে সততার পথ বেছে নিয়েছেন, তাঁর মৃত্যুর পর রাষ্ট্রের দায়িত্ব সত্য উদ্‌ঘাটন করা।”

ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, এই আবেদন কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পদক্ষেপ নয়; এটি একটি সাংস্কৃতিক কর্তব্য। সংগঠনের ভাষায়, “এটি কেবল একজন শিল্পীর জন্য ন্যায়ের দাবি নয়, এটি সমগ্র ভারতের সাংস্কৃতিক মর্যাদার প্রশ্ন।”

চিঠির শেষাংশে বঙ্গো ভাষী মহাসভা ফাউন্ডেশন লিখেছে, “আমরা বিশ্বাস করি, সত্য কখনও পরাজিত হয় না। দেরি হতে পারে, কিন্তু সত্যের আলো শেষ পর্যন্ত জ্বলে। জুবিন গার্গের আত্মা যেন সেই আলোর মধ্যেই শান্তি পায়—এই আমাদের প্রার্থনা।”

অসমের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন ইতিমধ্যেই বঙ্গো ভাষী মহাসভার এই উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়েছে। সাধারণ মানুষও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করছে তাঁদের আশা ও উদ্বেগ। গুয়াহাটির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এখন একটাই আলোচনা—এই রহস্যের অবসান কবে হবে?

অসমের জনগণের দাবি, কেন্দ্র যেন দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং সিবিআই তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য সামনে আনে। কারণ, জুবিন গার্গ শুধু একজন শিল্পী ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক প্রজন্মের অনুপ্রেরণা। তাঁর মৃত্যু যদি রহস্যে ঢেকে থাকে, তবে তা গোটা জাতির সাংস্কৃতিক বিবেকের পরাজয়।