বিহারের একটি প্রভাবশালী মুসলিম সংগঠন, ইমারত শরিয়া, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের (Nitish Kumar)আমন্ত্রণে ইফতারে যোগ না দেওয়ার ঘোষণা করেছে। এই সিদ্ধান্তটি ওয়াকফ (সংশোধন) বিলের প্রতি নীতীশ কুমারের “সমর্থনের” বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে নেওয়া হয়েছে। ইমারত শরিয়া, যারা বিহার, ঝাড়খণ্ড এবং ওড়িশা জুড়ে অনুসারী রয়েছে বলে দাবি করে, রবিবার (২৩ মার্চ, ২০২৫) মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনে আয়োজিত ইফতারের আমন্ত্রণের জবাবে একটি চিঠি প্রকাশ করেছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, “২৩ মার্চ সরকারি ইফতারে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে… এই সিদ্ধান্ত আপনার ওয়াকফ বিল সমর্থনের কারণে নেওয়া হয়েছে, যা মুসলিমদের অর্থনৈতিক এবং শিক্ষাগত পশ্চাদপটকে আরও খারাপ করার হুমকি দেয়।”
ওয়াকফ বিল নিয়ে বিতর্ক
ওয়াকফ (সংশোধন) বিল ২০২৪ গত বছরের আগস্টে লোকসভায় উত্থাপিত হয়েছিল এবং বর্তমানে এটি যৌথ সংসদীয় কমিটির (জেপিসি) বিবেচনাধীন রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার এই বিলকে ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনার একটি পদক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করলেও, মুসলিম সংগঠন এবং বিরোধী দলগুলি এটিকে সম্প্রদায়ের সম্পত্তির উপর সরকারের অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছে। ইমারত শরিয়ার অভিযোগ, এই বিল মুসলিম সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করবে এবং এটি সাংবিধানিকভাবে অগ্রহণযোগ্য।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, “আপনি ধর্মনিরপেক্ষ শাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন, যেখানে সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষিত থাকবে। কিন্তু বিজেপির সঙ্গে আপনার জোট এবং এই অসাংবিধানিক ও অযৌক্তিক আইনের প্রতি সমর্থন আপনার প্রতিশ্রুতির বিরুদ্ধে যায়।” সংগঠনটি মুখ্যমন্ত্রীর ইফতার আয়োজনকে “প্রতীকী আড়ম্বর” হিসেবে বর্ণনা করে বলেছে, “আপনার সরকার মুসলিমদের উদ্বেগের প্রতি উদাসীন, তাই এ ধরনের আনুষ্ঠানিক সমাবেশ অর্থহীন।”
আরো দেখুন চেপকে প্রাক্তন বনাম বর্তমান তিন অধিনায়কের লড়াই
নীতীশ কুমারের রাজনৈতিক অবস্থান
নীতীশ কুমারের দল জনতা দল (ইউনাইটেড) বা জেডি(ইউ) কেন্দ্রে এবং রাজ্যে বিজেপির সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে চলছে। জেডি(ইউ) ঐতিহ্যগতভাবে নীতীশ কুমারের “ধর্মনিরপেক্ষ” ইমেজের উপর ভর করে মুসলিম ভোটের একটি অংশের সমর্থন পেয়ে থাকে। তবে, এই ঘটনা এই ভোটব্যাঙ্কের উপর প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষ করে যেহেতু বিহারে এই বছরের শেষে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। এই প্রত্যাখ্যান নীতীশ কুমারের জন্য একটি রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা যাচ্ছে। ইমারত শরিয়ার এই পদক্ষেপের পর নীতীশ কুমার বা তাঁর দল থেকে তাৎক্ষণিক কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ঘটনা বিহারের রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি করতে পারে।
মুসলিম সম্প্রদায়ের ক্ষোভ
ইমারত শরিয়ার এই সিদ্ধান্ত শুধু একটি প্রতীকী প্রতিবাদ নয়, বরং এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের প্রতিফলন। ওয়াকফ বিলের কিছু প্রস্তাবিত সংশোধনী, যেমন ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিমদের অন্তর্ভুক্তি এবং সম্পত্তি জরিপের ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপ, সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। অনেকে মনে করেন, এই বিল ওয়াকফ সম্পত্তির স্বায়ত্তশাসনকে হ্রাস করবে এবং সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক স্বার্থের উপর আঘাত হানবে।
বিহারে মুসলিম জনসংখ্যা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৮ শতাংশ। এই সম্প্রদায়ের ভোট নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইমারত শরিয়ার মতো প্রভাবশালী সংগঠনের এই পদক্ষেপ অন্যান্য মুসলিম গোষ্ঠীকেও প্রভাবিত করতে পারে, যা নীতীশ কুমারের জন্য রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিকর হতে পারে।<
VIDEO | Bihar: On decision to boycott Iftar party called by CM Nitish Kumar, Nazim of Imarat Shariah, Sayedur Rahman Quasmi says, “Imarat Shariah has boycotted, because Nitish Kumar supports the Waqf Bill. But one thing everyone should know that we are not anguished with Nitish… pic.twitter.com/XTPhVvYocT
— Press Trust of India (@PTI_News) March 23, 2025
বিরোধীদের প্রতিক্রিয়া
বিরোধী দলগুলি, বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি), এই ঘটনাকে নীতীশ কুমারের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার চেষ্টা করতে পারে। আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদব ইতিমধ্যেই ওয়াকফ বিলের বিরোধিতা করে এসেছেন এবং নীতীশ কুমারের অবস্থানের সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, “বিজেপির অবস্থান এই বিল নিয়ে স্পষ্ট, কিন্তু নীতীশ কুমারের নীরবতা বিভ্রান্তিকর। তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেন, কিন্তু তাঁর কাজ তা প্রতিফলিত করে না।” এই পরিস্থিতি আরজেডির ‘এমওয়াই’ (মুসলিম-যাদব) সমীকরণকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।
বিহারের বাইরেও প্রভাব
ইমারত শরিয়ার এই সিদ্ধান্তের প্রভাব বিহারের বাইরেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। জমিয়ত উলামা-ই-হিন্দের মতো জাতীয় সংগঠনও ওয়াকফ বিলের বিরোধিতা করছে এবং এনডিএ-র মিত্রদলগুলির বিরুদ্ধে বয়কটের ডাক দিয়েছে। জমিয়তের প্রেসিডেন্ট মাওলানা আরশাদ মাদনী বলেছেন, “যারা ধর্মনিরপেক্ষতার দাবি করে এনডিএ-তে রয়েছেন, তাদের মুসলিমদের উপর অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে।” এই প্রেক্ষাপটে, বিহারে ২৬ মার্চ একটি বড় প্রতিবাদের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
নীতীশের চ্যালেঞ্জ
নীতীশ কুমারের জন্য এটি একটি কঠিন পরিস্থিতি। একদিকে, তিনি বিজেপির সঙ্গে জোটে থেকে কেন্দ্রীয় নীতি সমর্থন করছেন, অন্যদিকে তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ ইমেজ ধরে রাখতে হবে। জেডি(ইউ)-র মধ্যে এই বিল নিয়ে মতভেদ রয়েছে। যেখানে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাজীব রঞ্জন সিং বিলের সমর্থন করেছেন, সেখানে রাজ্যের মন্ত্রী বিজয় কুমার চৌধুরী এটির সমালোচনা করেছেন। এই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নীতীশের অবস্থানকে আরও জটিল করে তুলেছে।
ইমারত শরিয়ার এই প্রত্যাখ্যান বিহারের রাজনীতিতে একটি তাৎপর্যপূর্ণ মোড় হিসেবে দেখা যাচ্ছে। ওয়াকফ বিলের বিরোধিতা কেবল ধর্মীয় ইস্যু নয়, এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকারের প্রশ্নও। নির্বাচনের বছরে এই ঘটনা নীতীশ কুমারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। তিনি কীভাবে এই পরিস্থিতি সামলান, তা বিহারের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।