“সুরের কোনো সীমান্ত নেই”, জুবিন গার্গকে শ্রদ্ধা জানাতে সোনাপুরে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদল

Jubin Garg passes away

গুয়াহাটি: অসমের সীমানা পেরিয়ে জুবিন গার্গের (Zubin Garg) সুর ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলাদেশ পর্যন্ত। তাঁর গান, তাঁর কণ্ঠ, তাঁর সুর যেন দুই দেশের মানুষের হৃদয়ের সেতুবন্ধন। সেই সুরের বন্ধনে গাঁথা ভালোবাসার প্রকাশ ঘটল বৃহস্পতিবার, যখন বাংলাদেশ সরকারের এক উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল সোনাপুরে এসে প্রয়াত শিল্পীকে শ্রদ্ধা জানাল। তাঁদের এই সফর যেন প্রমাণ করল— শিল্প ও অনুভূতির কোনো ভৌগোলিক সীমা নেই।

Advertisements

বৃহস্পতিবার সকালে সোনাপুরের জুবিন ক্ষেত্র প্রাঙ্গণে এসে প্রতিনিধি দলটি শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করে প্রয়াত শিল্পীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে। বাংলাদেশ সরকারের এই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন গুয়াহাটিস্থিত বাংলাদেশ উপ-উচ্চ কমিশনার প্রীতি রহমান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশ সহকারী উচ্চ কমিশনার জিকরুল হাসান ফাহাদ। দলটি ফুল অর্পণ করে জুবিন গার্গের দাহস্থলে নীরবতা পালন করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন।

   

প্রীতি রহমানের চোখে মুখে ফুটে উঠেছিল গভীর আবেগ ও শ্রদ্ধা। তিনি বলেন, “এই বহুপ্রতিভাধর শিল্পী ও সৃষ্টিশীল কিংবদন্তির অসাধারণ কর্মজীবন বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়ে ছুঁয়ে গেছে। আমরা জুবিন গার্গের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই এবং তাঁদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছি। বাংলাদেশের মানুষও তাঁর আকস্মিক প্রয়াণে গভীরভাবে শোকাহত।”

তিনি আরও বলেন, “জুবিন গার্গ শুধু একজন গায়ক নন, তিনি ছিলেন এক সাংস্কৃতিক দূত। তাঁর সুর আমাদের দেশেও সমানভাবে জনপ্রিয় ছিল। তাঁর গান ‘ময়না গো ময়না’, ‘তুমি আসবে বলে’, কিংবা তাঁর সুরারোপিত অন্যান্য গান বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের হৃদয়ে আজও বেঁচে আছে। তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন তাঁর সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে।”

বাংলাদেশের উপ-উচ্চ কমিশনারের এই সফর জুবিন গার্গের মৃত্যুকে ঘিরে দুই দেশের শিল্পমহলের গভীর সংযোগকে আরও একবার সামনে নিয়ে এলো। জুবিন ছিলেন এমন এক শিল্পী, যাঁর কণ্ঠ সীমান্ত পেরিয়ে গিয়েছিল— অসম, পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ— সর্বত্রই তাঁর ভক্তের সংখ্যা অগণিত। জুবিন গার্গের জীবন ও শিল্পকর্ম এক বিস্ময়কর যাত্রা। অসমের শিবসাগরের ছেলে থেকে শুরু করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন উত্তর-পূর্ব ভারতের সাংস্কৃতিক প্রতীক। সঙ্গীত, সিনেমা, নাটক— সবক্ষেত্রেই তাঁর প্রভাব ছিল স্পষ্ট। তাঁর গানের ভাষা ছিল ভালোবাসা ও মানবতার ভাষা। তাই তাঁর মৃত্যুর খবর যখন ছড়িয়ে পড়ে, তখন কেবল অসম নয়, বাংলাদেশ থেকেও অগণিত ভক্ত শোকবার্তা পাঠান সামাজিক মাধ্যমে।

Advertisements

বাংলাদেশের বিভিন্ন শিল্পী ও সঙ্গীতপ্রেমী সংস্থাও তাঁর স্মৃতিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে অনুষ্ঠান আয়োজন করছে। ঢাকায় ও চট্টগ্রামে একাধিক স্থানে অনুষ্ঠিত হয়েছে স্মরণসভা, যেখানে গাওয়া হয়েছে তাঁর জনপ্রিয় গানগুলি। বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনে জুবিন গার্গের প্রভাব নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এক সংগীত বিশ্লেষক বলেন, “তিনি এমন একজন শিল্পী, যিনি প্রমাণ করেছেন সঙ্গীতের কোনো জাতি নেই, কোনো দেশ নেই। তাঁর সুর যেন দুই দেশের মাটির ঘ্রাণ এক করে দেয়।

বাংলাদেশে তাঁর ভক্তদের সংখ্যা কয়েক লক্ষে পৌঁছেছিল। তাঁর গান বাংলাদেশের টেলিভিশন ও সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়মিত বাজানো হতো।” প্রতিনিধিদলের এই সফরকে ঘিরে সোনাপুরের পরিবেশ ছিল আবেগময়। জুবিন ক্ষেত্র প্রাঙ্গণে তখন ভিড় জমিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা, ভক্তরা ও শিল্পীমহলের অনেকে। তাঁরা বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এই শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য। স্থানীয় শিল্পী তৃষ্ণা দাস বলেন, “জুবিনদা ছিলেন অসমের গর্ব, কিন্তু তিনিও ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার এক সাংস্কৃতিক সম্পদ। আজ বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল এসে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন— এটা আমাদের জন্য গর্বের মুহূর্ত।”

প্রতিনিধিদলটি প্রায় এক ঘণ্টা সময় কাটান জুবিন ক্ষেত্র-এ। তাঁরা স্মৃতি সৌধ ও সংগীত প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখেন এবং স্থানীয় শিল্পীদের কাছ থেকে তাঁর জীবনী ও কর্মজীবন সম্পর্কেও বিস্তারিত শোনেন। প্রয়াত শিল্পীর পরিবারের পক্ষ থেকেও এই সফরকে ‘অত্যন্ত সম্মানজনক ও আবেগপূর্ণ’ বলে উল্লেখ করা হয়। পরিবারের এক সদস্য বলেন, “জুবিনদার সঙ্গীতের কোনো সীমান্ত ছিল না।

আজ বাংলাদেশের মানুষ যে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন, সেটাই প্রমাণ করে তিনি সত্যিই আন্তর্জাতিক মানের শিল্পী ছিলেন।” শিল্প, সংস্কৃতি ও মানবতার সংযোগেই হয়তো জুবিন গার্গকে আজও মনে রাখছে মানুষ। তাঁর সুরের মায়া, তাঁর কণ্ঠের জাদু, আর তাঁর জীবনের গল্প— সব মিলিয়ে তিনি আজও দুই দেশের হৃদয়ে সমানভাবে জীবন্ত। যেমন প্রীতি রহমান বলেছিলেন— “জুবিন গার্গ আমাদের হৃদয়ে চিরকাল থাকবেন। তাঁর সুর কখনো থেমে থাকবে না; তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর গান, তাঁর ভালোবাসা আর তাঁর ভক্তদের অনন্ত স্মৃতিতে।”