রাবণের উদাহরণ টেনে হামলাকারীদের শিক্ষা দেওয়ার ‌‘মোহন-বার্তা’

জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনার পর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) প্রধান মোহন ভাগবত (Mohan Bhagwat) একটি গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা…

Mohan Bhagwat Stresses India's Non-Violence But Warns Oppressors Post J&K Attack

জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনার পর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) প্রধান মোহন ভাগবত (Mohan Bhagwat) একটি গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা দিয়েছেন। শনিবার নয়াদিল্লিতে ‘দ্য হিন্দু ম্যানিফেস্টো’ নামক বইয়ের প্রকাশনা উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, অহিংসা ভারতের ধর্ম এবং এর মূল্যবোধের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে, “অত্যাচারী ও দুষ্কৃতকারীদের” শিক্ষা দেওয়াও ভারতের ঐতিহ্যের অংশ। তিনি এই প্রসঙ্গে রামায়ণের রাবণের উদাহরণ টেনে বলেন, রাবণকে হত্যা করা হয়েছিল তার ক্ষতি করার জন্য নয়, বরং তার মঙ্গলের জন্যই।

মোহন ভাগবত তার বক্তৃতায় বলেন, “আমরা কখনো আমাদের প্রতিবেশীদের ক্ষতি করি না বা তাদের অসম্মান করি না। কিন্তু যদি কেউ জোর করে দুষ্টতার পথে চলে, তবে তার প্রতিকার কী? রাজার কর্তব্য হলো জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, আর তিনি তার কর্তব্য পালন করবেন। গীতা আমাদের অহিংসার শিক্ষা দেয়, কিন্তু সেই শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল অর্জুনকে যুদ্ধে প্ররোচিত করা এবং হত্যা করতে উৎসাহিত করা। কারণ, তার সামনে এমন মানুষ ছিল যাদের উন্নতি কেবল এই পথেই সম্ভব ছিল।”

   

তিনি আরও বলেন, “অহিংসা আমাদের স্বভাব, আমাদের মূল্যবোধ। আমাদের অহিংসার উদ্দেশ্য হলো মানুষকে পরিবর্তন করা এবং তাদেরও অহিংস করে তোলা। কিছু মানুষ আমাদের উদাহরণ দেখে পরিবর্তিত হবে, কিন্তু অনেকে হবে না। তারা যতই চেষ্টা করুক, পরিবর্তন হবে না এবং পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। তখন আমরা কী করব?”

জম্মু-কাশ্মীরের হামলা ও ভারতের প্রতিক্রিয়া

জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে সম্প্রতি সংঘটিত জঙ্গি হামলা ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থার উপর একটি বড় ধরনের আঘাত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই হামলায় ২৬ জন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, যা দেশজুড়ে ক্ষোভ ও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। এই প্রেক্ষাপটে মোহন ভাগবতের বক্তব্য একটি সুস্পষ্ট বার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে, যেখানে তিনি অহিংসার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় কঠোর পদক্ষেপের উপর জোর দিয়েছেন।

তিনি বলেন, ভারত সবসময় শান্তি ও সম্প্রীতির পক্ষে। কিন্তু যখন কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে দেশের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে ওঠে, তখন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এই বক্তব্যকে অনেকে পাকিস্তান-সমর্থিত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে একটি পরোক্ষ হুঁশিয়ারি হিসেবে বিবেচনা করছেন, যদিও তিনি সরাসরি কোনো দেশের নাম উল্লেখ করেননি।

অহিংসা ও প্রতিরোধের ভারতীয় দর্শন

মোহন ভাগবতের বক্তব্য ভারতীয় দর্শনের গভীর শিকড়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তিনি গীতার উদাহরণ টেনে বলেন, অহিংসা ভারতের আদর্শ হলেও, এটি দুর্বলতার প্রতীক নয়। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হতে বলেছিলেন, কারণ তখনকার পরিস্থিতিতে ন্যায় ও ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম অপরিহার্য ছিল। ভাগবতের মতে, একইভাবে আজকের দিনেও যারা সমাজে বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি ছড়ায়, তাদের প্রতিরোধ করা রাষ্ট্র ও সমাজের কর্তব্য।

তিনি আরও বলেন, ভারতের ঐতিহ্য হলো সকলের প্রতি সৌহার্দ্য ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করা। কিন্তু যখন কেউ এই শান্তির পরিবেশকে বিঘ্নিত করে, তখন তাদের শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। তিনি রাবণের উদাহরণ দিয়ে বলেন, রাবণের মৃত্যু তার নিজের উন্নতির জন্যই ছিল, কারণ তার দুষ্কর্ম তাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে গিয়েছিল।

রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া

মোহন ভাগবতের এই বক্তব্য ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক মহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকে তার বক্তব্যকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন। বিশেষ করে জম্মু-কাশ্মীরে ক্রমাগত জঙ্গি হামলার প্রেক্ষাপটে তার এই বক্তব্য সরকারের নিরাপত্তা নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।

অন্যদিকে, কিছু সমালোচক মনে করছেন, তার বক্তব্যে পরোক্ষভাবে প্রতিবেশী দেশগুলির প্রতি হুঁশিয়ারি থাকলেও, এটি অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিষয়ে চলমান আলোচনার মধ্যে তার এই বক্তব্য বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।

মোহন ভাগবতের বক্তব্য ভারতের অহিংসা ও প্রতিরোধের দ্বৈত দর্শনকে সামনে এনেছে। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, ভারত শান্তির পক্ষে, কিন্তু এই শান্তি দুর্বলতা নয়। পহেলগাঁও হামলার মতো ঘটনা দেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করলেও, ভাগবতের বক্তব্য থেকে এটাই স্পষ্ট যে, ভারত প্রয়োজনে কঠোর পদক্ষেপ নিতে পিছপা হবে না। তার এই বার্তা কেবল জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নেই নয়, ভারতের সাংস্কৃতিক ও দার্শনিক ঐতিহ্যের প্রেক্ষাপটেও গুরুত্বপূর্ণ।