ভারতীয় জনতা পার্টির (BJP) জাতীয় মুখপাত্র এবং নাগাল্যান্ডের প্রাক্তন মন্ত্রী মোহনলুমো কিকন (Mmhonlümo Kikon) বুধবার (৭ আগস্ট ২০২৫) দলের প্রাথমিক এবং সক্রিয় সদস্যপদ সহ সমস্ত পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। উত্তর-পূর্ব ভারতের একমাত্র জাতীয় মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত কিকন তাঁর পদত্যাগপত্রে জানিয়েছেন, তিনি “জনগণের সঙ্গে নতুনভাবে যুক্ত হওয়ার এবং নীতি-নির্ধারণী কাজে অবদান রাখার” ইচ্ছা থেকে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে, সূত্রের খবর, উত্তর-পূর্বের আদিবাসী সম্প্রদায়ের বিষয়ে দলের নীতি ও ব্যবস্থাপনার প্রতি তাঁর ক্রমবর্ধমান অসন্তোষও এই পদত্যাগের পেছনে একটি কারণ হতে পারে। বিজেপি এখনও এই পদত্যাগের বিষয়ে কোনও আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রকাশ করেনি।
মোহনলুমো কিকনের রাজনৈতিক যাত্রা
মোহনলুমো কিকন (জন্ম: ১ মে, ১৯৭৮) নাগাল্যান্ডের ওয়াখা জেলার ৪০ নম্বর ভান্দারি বিধানসভা কেন্দ্র থেকে দুইবারের বিধায়ক। তিনি ২০১৩ সালে ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টির (এনসিপি) টিকিটে এবং ২০১৮ সালে বিজেপির টিকিটে এই কেন্দ্র থেকে জয়ী হন। নাগাল্যান্ডে রাজ্য গঠনের পর তিনিই একমাত্র বিধায়ক যিনি এই কেন্দ্র থেকে টানা দুইবার জয়ী হয়েছেন। তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে তিনি নাগাল্যান্ড সরকারের ভূতত্ত্ব ও খনিজ এবং সীমান্ত বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও, তিনি তথ্যপ্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং নবায়নযোগ্য শক্তি বিভাগের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। ২০২০ সালে তাঁকে বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র নিযুক্ত করা হয়, এবং তিনি মিজোরামের প্রভারী (ইন-চার্জ) হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
কিকন শুধু রাজনীতিতেই নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী এই নেতা একজন প্রখ্যাত কবি। তাঁর দুটি কাব্যগ্রন্থ, দ্য ভিলেজ এম্পায়ার এবং দ্য পেনমি পোয়েমস: আ রেকুইয়েম, প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ২০০৬ সালে ডিআইসিই ফাউন্ডেশন নামে একটি এনজিও প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরিবেশ নীতি, টেকসই উন্নয়ন এবং গ্রামীণ নারীদের জীবিকার উপর কাজ করে। এছাড়াও, তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, জলবায়ু পরিবর্তন এবং টেকসই উন্নয়নের উপর সেমিনার ও কর্মশালায় অংশ নিয়ে ইউরোপ এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেছেন।
পদত্যাগের কারণ
কিকন তাঁর পদত্যাগপত্রে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি “নিজের যাত্রাকে পুনঃক্যালিব্রেট করতে” এবং “জনগণের সঙ্গে নতুনভাবে যুক্ত হওয়ার এবং নীতি-নির্ধারণী কাজে অবদান রাখার” ইচ্ছা থেকে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে, দলের অভ্যন্তরীণ সূত্র এবং বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে যে, উত্তর-পূর্বের আদিবাসী সম্প্রদায়ের বিষয়ে বিজেপির নীতি এবং ব্যবস্থাপনার প্রতি তাঁর ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ এই পদত্যাগের পেছনে একটি বড় কারণ হতে পারে। উত্তর-পূর্বের আদিবাসী সম্প্রদায়ের অধিকার এবং উন্নয়নের বিষয়ে কিকন সবসময় সোচ্চার ছিলেন, এবং তিনি বিজেপির জাতীয় কথোপকথনে এই অঞ্চলের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
উত্তর-পূর্ব রাজনীতিতে প্রভাব
কিকনের পদত্যাগ উত্তর-পূর্ব ভারতে, বিশেষ করে নাগাল্যান্ডে বিজেপির অবস্থানের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য ধাক্কা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিজেপি নাগাল্যান্ডে ন্যাশনালিস্ট ডেমোক্রেটিক প্রোগ্রেসিভ পার্টির (এনডিপিপি) নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের অংশীদার, যেখানে দলটির ১২ জন বিধায়ক রয়েছে। কিকনের মতো একজন প্রভাবশালী নেতার প্রস্থান দলের আদিবাসী ভোটব্যাঙ্কের উপর প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষ করে এমন সময়ে যখন আদিবাসী সম্প্রদায়ের বিষয়গুলি রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল।
এক্স-এ পোস্ট করা কিছু মন্তব্যে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, কিকনের পদত্যাগের পেছনে বিজেপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, উত্তর-পূর্বের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রতি অবহেলা, এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতি পদ্ধতিগত উপেক্ষার মতো বিষয়গুলি ভূমিকা রাখতে পারে। তবে, এই দাবিগুলি এখনও স্বাধীনভাবে যাচাই করা যায়নি। কিকনের পদত্যাগের ফলে বিজেপির উত্তর-পূর্বে প্রভাব বিস্তারের কৌশল, বিশেষ করে আদিবাসী-অধ্যুষিত এলাকায়, নতুন করে পর্যালোচনার মুখে পড়তে পারে।
পূর্বের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ
২০২৩ সালের নাগাল্যান্ড বিধানসভা নির্বাচনে কিকন ভান্দারি কেন্দ্র থেকে নাগা পিপলস ফ্রন্টের (এনপিএফ) প্রার্থী অচুমবেমো কিকনের কাছে পরাজিত হন। এই নির্বাচনে তিনি অ্যান্টি-ইনকামবেন্সি এবং প্রাক্তন সহযোগীদের মধ্যে অসন্তোষের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তাঁর প্রাক্তন সহযোগী নিয়ামো ওডিউও দাবি করেছিলেন যে, কিকন “জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়েছেন” এবং “গ্রাসরুট স্তরে পৌঁছতে পারেননি।” এই পরাজয় তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে একটি ধাক্কা হলেও, তিনি বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র হিসেবে তাঁর প্রভাব বজায় রেখেছিলেন।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
কিকনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে এখনও কোনও স্পষ্ট তথ্য নেই। তবে, তাঁর সামাজিক কাজ এবং নীতি-নির্ধারণী ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে অনুমান করা যায় যে, তিনি হয়তো উত্তর-পূর্বের আদিবাসী সম্প্রদায়ের উন্নয়ন এবং অধিকারের জন্য নতুন প্ল্যাটফর্মে কাজ করতে পারেন। তাঁর এনজিও, ডিআইসিই ফাউন্ডেশন, পরিবেশ এবং টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে কাজ করে, যা তাঁর ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের একটি ইঙ্গিত হতে পারে।
মোহনলুমো কিকনের পদত্যাগ বিজেপির জন্য উত্তর-পূর্বে একটি উল্লেখযোগ্য ক্ষতি, বিশেষ করে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে দলের প্রভাব বৃদ্ধির প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে। তাঁর পদত্যাগের পেছনের কারণ হিসেবে ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য উল্লেখ করা হলেও, আদিবাসী সমস্যার প্রতি দলের নীতির প্রতি অসন্তোষের বিষয়টি রাজনৈতিক মহলে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। আগামী দিনে কিকনের পদক্ষেপ এবং বিজেপির প্রতিক্রিয়া উত্তর-পূর্বের রাজনীতিতে নতুন গতিপথ নির্ধারণ করতে পারে।