২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে ঘটে এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন। দীর্ঘ ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট (Left Front) সরকারের পতন ঘটে এবং রাজ্যে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল কংগ্রেস। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে শুরু হয় তৃণমূল জমানা। তবে এই রাজনৈতিক পরিবর্তনের পেছনে অন্যতম ভূমিকা ছিল প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের (Manmohan Singh)। এমনকি সিপিআইএমের বহু শীর্ষ নেতা এই বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
মনমোহন সিং: অর্থনীতির স্থপতি ও রাজনীতির কুশলী
মনমোহন সিং একদিকে যেমন ভারতের অর্থনীতির নবজাগরণ ঘটিয়েছিলেন, তেমনি রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও তাঁর সিদ্ধান্তগুলির প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। ১৯৯১ সালে অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন অর্থনৈতিক সংস্কার থেকে শুরু করে ২০০৪-২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে তিনি একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তাঁর জমানার অন্যতম বিতর্কিত এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল ২০০৮ সালে আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তি।
পরমাণু চুক্তি ও রাজনৈতিক অস্থিরতা
২০০৮ সালে ইউপিএ-২ সরকারের প্রধান হিসেবে মনমোহন সিং যখন আমেরিকার সঙ্গে ভারতের পরমাণু চুক্তি করেন, তখন তা দেশজুড়ে তোলপাড় ফেলে দেয়। বামেরা, যারা সেই সময় ইউপিএ সরকারের প্রধান শরিক ছিল, এই চুক্তির তীব্র বিরোধিতা করে। তারা অভিযোগ তোলে, এই চুক্তি ভারতের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হানতে পারে।
বামেদের বিরোধিতা এতটাই তীব্র হয় যে, তারা ইউপিএ সরকার থেকে তাদের সমর্থন তুলে নেয়। মনমোহন সিং অবশ্য তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন এবং সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করেন। কিন্তু বামেরা তাদের সমর্থন তুলে নেওয়ার ফলে রাজনৈতিক ভারসাম্য বদলে যায়।
বাংলার রাজনীতিতে পরিবর্তনের সূচনা
বামেদের সমর্থন প্রত্যাহারের এই সিদ্ধান্তের পরিণতি ধীরে ধীরে বাংলার রাজনীতিতে স্পষ্ট হতে শুরু করে। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস বড়সড় সাফল্য পায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল ক্রমশ শক্তি বাড়াতে থাকে, এবং বামেরা দুর্বল হতে থাকে।
২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে বামেদের বড় বড় নেতারাও পরাস্ত হন। এটি ছিল তৃণমূলের উত্থানের সূচনা এবং সিপিআইএমের জন্য একটি কঠিন সময়ের শুরু। অনেক পলিটব্যুরো নেতা এবং বিশ্লেষক স্বীকার করেন যে, ইউপিএ সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করা একটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল, যা বামেদের জন্য এক দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়।
২০১১: বামের পতন এবং তৃণমূলের উত্থান
২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের সাফল্য তৃণমূলের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। এরপর ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস বামফ্রন্টকে পরাজিত করে। এই নির্বাচনেই সিপিআইএমের ৩৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটে এবং পশ্চিমবঙ্গে শুরু হয় তৃণমূলের যুগ।
সিপিআইএম নেতাদের স্বীকারোক্তি
সিপিআইএমের বহু শীর্ষ নেতা পরবর্তী সময়ে স্বীকার করেন যে, ২০০৮ সালে ইউপিএ-২ সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করা একটি বড় রাজনৈতিক ভুল ছিল। সেই সিদ্ধান্তের পরিণতিতে বাংলার রাজনীতিতে বামেরা দুর্বল হতে শুরু করে। এক নেতার কথায়, “আমরা যদি সেই সময় ইউপিএ সরকারে থেকে যেতাম, তাহলে বাংলায় রাজনৈতিক মেরুকরণ এত দ্রুত হত না।”
তৃণমূলের শক্তিবৃদ্ধি
২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে তৃণমূলের সাফল্যের পর থেকে রাজ্যের প্রতিটি নির্বাচনে বামেদের ভরাডুবি হয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল ক্রমশ শক্তি বৃদ্ধি করে এবং তিন দফায় রাজ্যে ক্ষমতায় আসতে সক্ষম হয়।
মনমোহন সিংয়ের একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, যা মূলত কেন্দ্রের পরমাণু চুক্তিকে কেন্দ্র করে নেওয়া হয়েছিল, তার পরোক্ষ প্রভাব পড়ে বাংলার রাজনীতিতে। বামেদের সমর্থন প্রত্যাহার এবং তার পরবর্তী ঘটনাক্রম তৃণমূলের উত্থানকে ত্বরান্বিত করে। আজ, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের শক্তিশালী অবস্থানের পেছনে মনমোহন সিংয়ের সেই সময়কার সিদ্ধান্তের প্রভাব অস্বীকার করার সুযোগ নেই।