মণিপুরে ২০২৩ সালের মে মাসে শুরু হওয়া মেইতেই-কুকি জাতিগত সংঘাতের ফলে বাস্তুচ্যুত হওয়া হাজার হাজার মানুষের জন্য রাজ্য সরকার একটি তিন-পর্যায় পরিকল্পনা (Manipur 3-Phase Plan) ঘোষণা করেছে। শুক্রবার, ৪ জুলাই ২০২৫, রাজ্যের প্রধান সচিব প্রশান্ত কুমার সিং ইম্ফলের সাংবাদিকদের জানিয়েছেন যে, এই পরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের নিরাপদে তাঁদের বাড়িতে ফিরিয়ে আনা এবং তাঁদের জীবন পুনর্গঠনের জন্য শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা হবে। তিনি আরও বলেন, শীঘ্রই রাজ্যে মানুষের অবাধ চলাচল সম্ভব হবে।
প্রধান সচিব জানান, “ইম্ফলে এবং দিল্লিতে অনেক কিছু ঘটছে। কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার এবং সুশীল সমাজের সংগঠনগুলো ঘনিষ্ঠভাবে সমন্বয় করে কাজ করছে।” তিনি উল্লেখ করেন যে, মেইতেই-কুকি সংঘাতের পর থেকে রাজ্যে পরিস্থিতি অনেকটাই উন্নত হয়েছে, যদিও এক-দুটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা এখনও ঘটছে। তবে, তিনি আশাবাদী যে, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে মণিপুরে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে।
উন্নতির লক্ষণ এবং শান্তিপূর্ণ কৃষিকাজ
প্রধান সচিব সিং জানান, রাজ্যে শান্তি ফিরে আসার লক্ষণ স্পষ্ট। মেইতেই এবং কুকি সম্প্রদায়ের কৃষকরা এখন তাঁদের ক্ষেতে কাজ করছেন এবং পাশাপাশি কাজ করার সময় পানির মতো সম্পদ ভাগাভাগি করছেন। তিনি বলেন, “কৃষিকাজ শান্তিপূর্ণভাবে চলছে। উভয় সম্প্রদায়ের কৃষকরা একে অপরের খুব কাছাকাছি কাজ করছেন এবং পানি ভাগ করে নিচ্ছেন। এটি একটি ইতিবাচক সংকেত।” তবে, তিনি সতর্ক করে বলেন, কিছু দুষ্কৃতকারী এখনও শান্তি বিনষ্ট করার চেষ্টা করতে পারে। তিনি গণমাধ্যমের কাছে সঠিক তথ্য যাচাই করে প্রকাশের আহ্বান জানান।
২০২৩ সালের মে মাস থেকে মণিপুরে জাতিগত সংঘাতে ২৬০ জনেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন এবং প্রায় ৬২,০০০ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। বর্তমানে, রাজ্যের বিভিন্ন ত্রাণ শিবিরে প্রায় ৫৭,০০০ মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। এই সংঘাতের ফলে ইম্ফল উপত্যকার মেইতেই সম্প্রদায় এবং পাহাড়ি অঞ্চলের কুকি-জো সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। তবে, প্রধান সচিবের মতে, পরিস্থিতি এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে।
তিন-পর্যায় পুনর্বাসন পরিকল্পনা
মণিপুর সরকারের তিন-পর্যায় পরিকল্পনা বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের নিরাপদে বাড়ি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে গৃহীত হয়েছে। প্রধান সচিব জানান, প্রথম পর্যায়ে জুলাই মাসে শুরু হবে, যেখানে যাঁরা তাৎক্ষণিকভাবে ফিরতে চান, তাঁদের ফিরিয়ে আনা হবে। দ্বিতীয় পর্যায় অক্টোবরে এবং তৃতীয় ও চূড়ান্ত পর্যায় ডিসেম্বরে সম্পন্ন হবে। এই পরিকল্পনার মাধ্যমে ডিসেম্বরের মধ্যে সমস্ত ত্রাণ শিবির বন্ধ করার লক্ষ্য নিয়েছে সরকার।
প্রশান্ত কুমার সিং জানান, “প্রথমে যাঁরা তাৎক্ষণিকভাবে ফিরতে চান, তাঁদের জন্য জুলাইয়ে প্রক্রিয়া শুরু হবে। ইতিমধ্যেই অনেকে ফিরতে শুরু করেছেন। সংখ্যাটি ৬২,০০০ থেকে কমে ৫৭,০০০-এ নেমেছে। চুরাচান্দপুর এবং কাংপোকপি জেলায় আমি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছি।” তিনি আরও বলেন, সরকার তিন ধরনের সহায়তা প্রদান করবে:
১. ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘরের জন্য আর্থিক সহায়তা: প্রায় ৮,০০০ ব্যক্তি, যাঁদের ঘর সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে, তাঁদের প্রত্যেককে ৩.০৩ লক্ষ টাকা (১.৩ লক্ষ এবং ১.৭ লক্ষ টাকা) দেওয়া হবে ঘর পুনর্নির্মাণের জন্য।
২. ক্ষতিগ্রস্ত ঘরের জন্য সহায়তা: প্রায় ৭,০০০ ব্যক্তি, যাঁদের ঘর ধ্বংস হয়নি কিন্তু দুই বছরের অবহেলায় জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে, তাঁদের জন্য আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে।
৩. অস্থায়ী আশ্রয়: ডিসেম্বরের পরেও যাঁরা ফিরতে পারবেন না, বিশেষ করে মোরেহ, চুরাচান্দপুর এবং কাংপোকপি থেকে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিরা, তাঁদের জন্য সরকার ১,০০০টিরও বেশি প্রি-ফেব্রিকেটেড ঘর নির্মাণ করছে।
অবাধ চলাচল ও শান্তি প্রতিষ্ঠা
প্রধান সচিব জানান, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার সুশীল সমাজের সংগঠনগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে রাজ্যের প্রধান মহাসড়কগুলোতে অবাধ চলাচল পুনঃস্থাপনের জন্য কাজ করছে। তিনি বলেন, “বর্তমান গতিতে আমরা আশাবাদী যে, শীঘ্রই প্রধান সড়কগুলোতে মানুষ নির্ভয়ে চলাচল করতে পারবেন।” এই উদ্যোগের মাধ্যমে রাজ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।
চ্যালেঞ্জ এবং সতর্কতা
প্রধান সচিব সতর্ক করে বলেন, কিছু দুষ্কৃতকারী এখনও শান্তি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। উদাহরণস্বরূপ, গত ১৯ জুন বিষ্ণুপুর জেলার ফুবালা গ্রামে একজন মেইতেই কৃষকের উপর অজ্ঞাত ব্যক্তিরা গুলি চালায়, যার ফলে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে গোলাগুলি হয়। এই ঘটনায় একজন কুকি বয়োজ্যেষ্ঠ নারী নিহত হন। এই ধরনের ঘটনা শান্তি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করলেও, সরকার এই সমস্যাগুলো মোকাবিলায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
প্রধানমন্ত্রীর সম্ভাব্য সফর
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মণিপুর সফরের গুঞ্জন প্রসঙ্গে প্রধান সচিব বলেন, এ বিষয়ে এখনও কোনো সরকারি নিশ্চিত তথ্য নেই। তিনি বলেন, “আমাদের কাছে এখনও কোনো তথ্য নেই। প্রত্যাশা আছে, কিন্তু এখনও কিছু নিশ্চিত হয়নি।”
মণিপুরের তিন-পর্যায় পুনর্বাসন পরিকল্পনা রাজ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আর্থিক সহায়তা, অস্থায়ী আশ্রয় এবং অবাধ চলাচলের উদ্যোগের মাধ্যমে সরকার বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের জীবন পুনর্গঠনে কাজ করছে। প্রধান সচিবের আশাবাদ এবং সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সহযোগিতার ইতিবাচক সংকেত মণিপুরের ভবিষ্যতের জন্য আশার আলো দেখাচ্ছে।