মুম্বই: ভারতের বিচারবিভাগীয় ইতিহাসে এক দীর্ঘতম ও বহুচর্চিত সন্ত্রাসবিরোধী মামলার অবসান ঘটল বৃহস্পতিবার। ২০০৮ সালের মালেগাঁও বিস্ফোরণ মামলায় বিজেপি সাংসদ প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর, লেফটেন্যান্ট কর্নেল প্রসাদ পুরোহিত সহ সাতজন অভিযুক্তকেই বেকসুর খালাস করল বিশেষ এনআইএ আদালত (Malegaon Blast Acquittal)।
আদালতের পর্যবেক্ষণ, “সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে নিঃসন্দেহে এটি একটি গুরুতর অপরাধ, কিন্তু নৈতিকতাকে ভিত্তি করে শাস্তি দেওয়া যায় না। অপরাধ প্রমাণে সন্দেহাতীত তথ্যপ্রমাণ না থাকলে আদালত কাউকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারে না।”
এই মামলার রায়ের মধ্য দিয়ে শেষ হল সেই অধ্যায়, যার সূত্র ধরেই ভারতে প্রথমবার রাষ্ট্রীয় পরিসরে উচ্চারিত হয়েছিল বিতর্কিত শব্দবন্ধ, ‘হিন্দু সন্ত্রাস’।
বিস্ফোরণের পর সন্ত্রাস, তদন্ত ও বিচারের দীর্ঘ পথচলা
২০০৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় মহারাষ্ট্রের মালেগাঁও শহরে, রমজানের সময়ে এক মোটরবাইকে বিস্ফোরক বেঁধে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। মৃত্যু হয় ৬ জনের, আহত হন ১০০-র বেশি মানুষ, অধিকাংশই মুসলিম সম্প্রদায়ের।
প্রাথমিক তদন্তে নামে মহারাষ্ট্র পুলিশের অ্যন্টি-টেররিজম স্কোয়াড (ATS)। পরে মামলা হস্তান্তরিত হয় জাতীয় তদন্ত সংস্থা (NIA)-র কাছে। ATS অভিযোগ করে, হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ‘অভিনব ভারত’-এর সঙ্গে যুক্ত একাধিক প্রাক্তন সেনাকর্মী ও ধর্মীয় নেতার যৌথ ষড়যন্ত্রেই ঘটানো হয়েছিল এই হামলা। মূল অভিযুক্ত হিসেবে উঠে আসে বিজেপি নেত্রী প্রজ্ঞা ঠাকুর এবং সেনাবাহিনীর গোপন শাখার অফিসার কর্নেল প্রসাদ পুরোহিতের নাম।
কী বলল আদালত?
১৭ বছরের বিচারপ্রক্রিয়ার শেষে, বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণায় বিচারক এ কে লাহোটি বলেন, “এই মামলায় তথ্যপ্রমাণ যতটা থাকা উচিত ছিল, তা আসেনি। শুধুমাত্র সন্দেহের ভিত্তিতে ফৌজদারি দণ্ড দেওয়া যায় না। অভিযুক্তরা অপরাধী, এমন দাবি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পারেনি সরকার পক্ষ।”
আদালত জানায়, বিস্ফোরকে ব্যবহৃত মোটরবাইকের মালিকানা প্রজ্ঞা ঠাকুরের বলে যে দাবি করা হয়েছিল, তা নিশ্চিত করা যায়নি। একইসঙ্গে কর্নেল পুরোহিতের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক জোগাড় ও ষড়যন্ত্রের প্রমাণও “নির্ভরযোগ্য ও পর্যাপ্ত নয়” বলে মনে করে আদালত।
‘অভিনব ভারত’ সংগঠনের বিরুদ্ধেও কোনও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে জড়িত থাকার যোগ্য তথ্য মেলেনি বলে রায়ে বলা হয়।
যাঁরা খালাস পেলেন
১. প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর
২. লেফটেন্যান্ট কর্নেল প্রসাদ পুরোহিত
৩. মেজর (অব.) রমেশ উপাধ্যায়
৪. সুধাকর চতুর্বেদী
৫. সুধাকর ধর দ্বিবেদী ওরফে শঙ্করাচার্য
৬. অজয় রাহিরকর
৭. সমীর কুলকার্নি
রাজনীতি, বিতর্ক এবং ভবিষ্যতের প্রতিধ্বনি
এই মামলার রায় প্রকাশ্যে আসতেই ফের তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে দেশের রাজনৈতিক মহলে। বিরোধীরা অতীতে দাবি করেছিলেন, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা রাজনৈতিক প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে তদন্ত চালিয়েছে। এখন আদালতের রায়কে শাসকদল ‘ন্যায়ের জয়’ হিসেবে ব্যাখ্যা করছে।
যদিও প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, প্রায় দুই দশক ধরে অভিযুক্তদের দোষী ভেবে সমাজের একাংশ যে মনস্তাত্ত্বিক শাস্তি দিয়েছে, তার দায় কে নেবে? এবং ‘সন্ত্রাস’ শব্দটি যখন কোনও বিশেষ ধর্ম বা গোষ্ঠীর সঙ্গে জুড়ে যায়, তখন সে অপরাধের বিচার শুধু আদালতে নয়, ইতিহাসেও হয়।
এই রায় শুধু এক মামলার সমাপ্তি নয়, বরং দেশের বিচারপ্রক্রিয়া, রাজনৈতিক পরিবেশ ও ধর্মনিরপেক্ষতার মূল্যবোধ ঘিরে নতুন করে ভাবনার অবকাশ সৃষ্টি করল।