তামিলনাড়ুর (Tamil Nadu) নীলগিরি জেলার নীলাকোট্টাই ফরেস্ট রিজার্ভে একটি পুরুষ বাঘের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই ঘটনাটি ঘটেছে এদাক্কোডু মাঠ এলাকায়, যা ভিলাঙ্গুর থানার অধীনে অবস্থিত। মুদুমালাই টাইগার রিজার্ভের অন্তর্গত নীলাকোট্টাই ফরেস্ট রিজার্ভের বন কর্মকর্তার বক্তব্য অনুযায়ী, বুধবার মাঠ পরিদর্শনের সময় এই বাঘটির মৃতদেহ দেখতে পাওয়া যায়। এরপর বৃহস্পতিবার জাতীয় বাঘ সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষের (এনটিসিএ) নির্দেশিকা মেনে মৃতদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়।
ময়নাতদন্ত প্রক্রিয়াটি মুদুমালাই টাইগার রিজার্ভের উপ-পরিচালক, উদালাই বিভাগের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। এই কাজে অংশ নেন সহকারী বন প্রাণী চিকিৎসক রাজেশ কুমার, সহকারী বন কর্মকর্তা অজেশ মোহনদাস এবং ইন্দুজা মায়া। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন এনজিও কর্মী, জনপ্রতিনিধি এবং বন বিভাগের অন্যান্য আধিকারিকরা। ময়নাতদন্ত রিপোর্টে জানা গেছে, মৃত বাঘটির বয়স ছিল প্রায় ১০ বছর এবং এটি মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়েছিল। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই আঘাত সম্ভবত অন্য একটি বাঘের আক্রমণের ফলে হয়েছে।
মুদুমালাই টাইগার রিজার্ভ: একটি প্রাকৃতিক সম্পদের আধার
মুদুমালাই টাইগার রিজার্ভ তামিলনাড়ুর নীলগিরি জেলায় অবস্থিত। এটি তিনটি রাজ্য—কর্ণাটক, কেরল এবং তামিলনাড়ুর সংযোগস্থলে বিস্তৃত। এই রিজার্ভটির মোট আয়তন ৬৮৮.৫৯ বর্গ কিলোমিটার। এটি নীলগিরি জৈবমণ্ডল রিজার্ভের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যিনি ১৯৮৬ সালে ভারতের প্রথম জৈবমণ্ডল রিজার্ভ হিসেবে ঘোষিত হয়েছিল। এই অঞ্চলটি বাঘ এবং এশীয় হাতির মতো প্রধান প্রজাতির সংরক্ষণে অনন্য ভূমিকা পালন করে।
মুদুমালাইয়ের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট অনুসারে, এই রিজার্ভের সীমানা পশ্চিমে ওয়াইনাড় ওয়াইল্ডলাইফ স্যাঙ্কচুয়ারি (কেরল), উত্তরে বান্দিপুর টাইগার রিজার্ভ (কর্ণাটক), দক্ষিণ ও পূর্বে নীলগিরি বিভাগ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে গুদালুর ফরেস্ট বিভাগের সঙ্গে যুক্ত। এই বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড একটি বৃহৎ সংরক্ষণ ল্যান্ডস্কেপ গঠন করেছে, যা বন্যপ্রাণীদের জন্য একটি আদর্শ আবাসস্থল। ফরেস্ট সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ২০০৯ সালের মূল্যায়ন অনুযায়ী, মুদুমালাই টাইগার রিজার্ভে অত্যন্ত ঘন জঙ্গল রয়েছে ৪৭.০৫ বর্গ কিলোমিটার, মাঝারি ঘন জঙ্গল ২১৪.৯৮ বর্গ কিলোমিটার এবং খোলা জঙ্গল ৫৬.১৬ বর্গ কিলোমিটার।
বাঘের মৃত্যু: প্রকৃতির নিষ্ঠুর নিয়ম?
বাঘের মতো শক্তিশালী ও রাজকীয় প্রাণীর মৃত্যু সবসময়ই আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে যখন এই মৃত্যু অন্য একটি বাঘের আক্রমণের ফলে ঘটে, তখন প্রকৃতির নিজস্ব নিয়ম ও ভারসাম্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। বন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাঘদের মধ্যে আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব বা আধিপত্য বিস্তারের জন্য লড়াইয়ের ঘটনা অস্বাভাবিক নয়। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ বাঘরা প্রায়ই নিজেদের এলাকা রক্ষা করতে বা নতুন এলাকা দখল করতে অন্য বাঘের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এই ক্ষেত্রে মৃত বাঘটির মাথায় আঘাতের চিহ্ন থেকে এমনটাই মনে করা হচ্ছে।
ময়নাতদন্ত রিপোর্টে আরও জানা গেছে, বাঘটির শরীরে অন্য কোনো রোগ বা বাইরের হস্তক্ষেপের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। এটি নিশ্চিত করে যে মৃত্যুর কারণ প্রাকৃতিক দ্বন্দ্ব ছাড়া অন্য কিছু নয়। তবে এই ঘটনা বন বিভাগের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপন করেছে—বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাদের আবাসস্থলের সীমাবদ্ধতা এবং খাদ্যের প্রতিযোগিতা কি এমন সংঘর্ষের কারণ হয়ে উঠছে?
বাঘ সংরক্ষণে ভারতের প্রচেষ্টা
ভারত বাঘ সংরক্ষণে বিশ্বে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। জাতীয় বাঘ সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ (এনটিসিএ) এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে। মুদুমালাইয়ের মতো টাইগার রিজার্ভগুলি শুধু বাঘের জন্যই নয়, অন্যান্য বন্যপ্রাণী এবং জৈববৈচিত্র্য রক্ষার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে বাঘের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাদের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা ও খাদ্য নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নীলাকোট্টাইয়ের এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে প্রকৃতির নিয়মে বেঁচে থাকার লড়াই কতটা কঠিন। বাঘের মতো শক্তিশালী প্রাণীও এই লড়াইয়ে হেরে যেতে পারে। বন বিভাগ এখন এই ঘটনার পেছনের বিস্তারিত কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা এড়াতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তা নিয়ে আলোচনা করছে।
স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
নীলাকোট্টাই এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা এই ঘটনায় উদ্বিগ্ন। বাঘের মৃত্যু তাদের কাছে শুধু একটি বন্যপ্রাণীর ক্ষতি নয়, বরং এই অঞ্চলের পরিবেশগত ভারসাম্যের উপর একটি প্রশ্নচিহ্ন। অনেকে মনে করেন, বন্যপ্রাণীদের সুরক্ষার জন্য আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। বন বিভাগ জানিয়েছে, তারা এই ঘটনার তদন্ত চালিয়ে যাবে এবং ভবিষ্যতে এমন দ্বন্দ্ব কমাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
নীলগিরির এই ঘটনা আমাদের সকলকে ভাবতে বাধ্য করে—প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে সহাবস্থান কতটা সম্ভব? বাঘের মতো প্রাণীর সংরক্ষণ শুধু বন বিভাগের দায়িত্ব নয়, এটি আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল।