বিহারে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে মাখানা (Makhana Prices) উৎপাদন ও এর দাম একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী ইস্যু হয়ে উঠেছে। বিহার বিশ্বের প্রায় ৯০ শতাংশ মাখানা উৎপাদন করে, যার মধ্যে মিথিলাঞ্চল, কোশি এবং সিমাঞ্চল অঞ্চলের জেলাগুলি যেমন দারভাঙ্গা, মধুবনী, সাহারসা, পূর্ণিয়া এবং কাটিহার প্রধান ভূমিকা পালন করে।
তবে, এই সুপারফুডের আকাশছোঁয়া দাম সত্ত্বেও কৃষক ও শ্রমিকরা তাদের পরিশ্রমের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। গ্রাউন্ড রিপোর্টে দেখা গেছে, মাখানা চাষে জড়িত মল্লাহ সম্প্রদায়ের কৃষক ও শ্রমিকরা অত্যন্ত দরিদ্র অবস্থায় রয়েছেন, এবং তাদের অভিযোগ, মধ্যস্বত্বভোগীরা মুনাফার বড় অংশ নিয়ে নিচ্ছেন।
মাখানা চাষ একটি শ্রমসাধ্য প্রক্রিয়া। কৃষকরা জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসে বীজ বপন করেন এবং জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসে ফসল সংগ্রহ করেন। এই প্রক্রিয়ায় কৃষক ও শ্রমিকদের জলাশয়ে ডুব দিয়ে মাখানার বীজ সংগ্রহ করতে হয়, যা ঝুঁকিপূর্ণ এবং শারীরিকভাবে কঠিন। দারভাঙ্গার কৃষক ফুল দেব শাহনি জানান, “আমরা দিনে সাত থেকে আট ঘণ্টা জলে ডুবে কাজ করি।
কাঁটাযুক্ত গাছের কারণে শরীরে ক্ষত হয়, ত্বকের সংক্রমণ হয়। কিন্তু আমাদের পরিশ্রমের তুলনায় দাম পাই না।” বড় শহরে মাখানার দাম কিলোগ্রাম প্রতি ১০০০ থেকে ২০০০ টাকা হলেও, কৃষকরা কাঁচা মাখানা বিক্রি করেন মাত্র ৩০০ টাকা কিলোগ্রামে।
কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী সম্প্রতি তাঁর ‘ভোটার অধিকার যাত্রা’-র সময় কাটিহারের মাখানা ক্ষেতে গিয়ে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, “বিহারে বিশ্বের ৯০ শতাংশ মাখানা উৎপাদিত হয়, কিন্তু কৃষক ও শ্রমিকরা মুনাফার ১ শতাংশও পায় না। এই পরিশ্রমী মানুষেরা, যারা এই শিল্পের মূল ভিত্তি, তারা দলিত ও অতি পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের।
৯৯ শতাংশ পরিশ্রম তাদের, কিন্তু মুনাফা যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে।” তিনি আরও অভিযোগ করেন যে বর্তমান সরকার কৃষকদের আয় বাড়ানোর বা ন্যায়বিচার প্রদানের কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
মাখানা চাষের সমস্যাগুলির মধ্যে রয়েছে নিম্ন উৎপাদনশীলতা, শ্রমসাধ্য পদ্ধতি, এবং পর্যাপ্ত প্রক্রিয়াকরণ ও বিপণন অবকাঠামোর অভাব। ঐতিহ্যবাহী চাষ পদ্ধতিতে হেক্টরপ্রতি ১.৭-১.৯ টন ফলন হয়, যেখানে উচ্চ ফলনশীল বীজ যেমন ‘স্বর্ণ বৈদেহী’ বা ‘সবৌর মাখানা-১’ ব্যবহার করলে ফলন ৩-৩.৫ টন পর্যন্ত বাড়তে পারে।
তবে, অনেক কৃষক এই উন্নত বীজ সম্পর্কে সচেতন নন বা এগুলি ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা পান না। উপরন্তু, বন্যার কারণে ফসল নষ্ট হওয়া এবং প্রক্রিয়াকরণের অভাবে কৃষকদের কম দামে কাঁচা মাখানা বিক্রি করতে হয়।
কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২৫-২৬-এ অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ বিহারে মাখানা বোর্ড গঠনের ঘোষণা করেছেন, যা উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ এবং বিপণন উন্নত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করবে। এই বোর্ড কৃষকদের প্রশিক্ষণ, আর্থিক সহায়তা এবং উন্নত প্রযুক্তি প্রদান করবে। এছাড়া, বিহারে একটি জাতীয় খাদ্য প্রযুক্তি, উদ্যোক্তা ও ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউট স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
তবে, কৃষকদের অভিযোগ, এই ঘোষণাগুলি এখনও বাস্তবায়িত হয়নি, এবং তারা এখনও মধ্যস্বত্বভোগীদের উপর নির্ভরশীল। কংগ্রেসের মুখপাত্র জ্ঞান রঞ্জন গুপ্ত বলেন, “মাখানা বোর্ড এখনও গঠিত হয়নি। মোদী সরকার কেবল ঘোষণা করে, কিন্তু বাস্তবায়ন করে না। মহাগঠবন্ধন ক্ষমতায় এলে কৃষকদের সমস্যার সমাধান করবে।”
রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, মাখানা চাষ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু, কারণ মিথিলাঞ্চল অঞ্চলের ১০০টিরও বেশি বিধানসভা আসন এনডিএ-র নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। মল্লাহ সম্প্রদায়, যারা মাখানা চাষে প্রধান ভূমিকা পালন করে, রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
এই সম্প্রদায়ের সমর্থন পেতে বিজেপি এবং বিরোধী উভয়ই মাখানা কৃষকদের সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। বিহারের কৃষিমন্ত্রী মঙ্গল পাণ্ডে জানিয়েছেন, সরকার মাখানা চাষের জন্য সর্বোচ্চ ৯৭,০০০ টাকা প্রতি হেক্টর ভর্তুকি দিচ্ছে এবং আগামী তিন বছরে চাষের ক্ষেত্রফল ৬০,০০০ হেক্টরে বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
তবে, গ্রাউন্ড রিপোর্টে দেখা গেছে, কৃষকরা এখনও পর্যাপ্ত স্টোরেজ সুবিধা, প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট এবং রপ্তানি অবকাঠামোর অভাবে ভুগছেন। দারভাঙ্গার কৃষক ধীরেন্দ্র কুমার, যিনি ধান চাষ ছেড়ে মাখানা চাষ শুরু করেছেন, বলেন, “আমরা উন্নত বীজ ও প্রশিক্ষণ পেয়েছি, কিন্তু বাজারে সরাসরি বিক্রির সুযোগ নেই। মধ্যস্বত্বভোগীরা আমাদের ফসল কম দামে কিনে নেয়।” বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মাখানার জন্য ন্যূনতম সমর্থন মূল্য (এমএসপি) ঘোষণা এবং ফুড প্রসেসিং ইউনিট স্থাপনের মাধ্যমে কৃষকদের আয় বাড়ানো সম্ভব।
ছত্তীসগড়ে মহুয়া মৈত্রর বিরুদ্ধে এফআইআর, অমিত শাহকে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য
মাখানা চাষের সম্ভাবনা বিশাল, তবে কৃষক ও শ্রমিকদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে সরকারকে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। নির্বাচনের এই সময়ে মাখানা কৃষকদের সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবায়িত হয়, তা দেখার বিষয়।