তৃণমূল কংগ্রেসের (টিএমসি) কৃষ্ণনগরের সাংসদ মহুয়া মৈত্র (Mahua Moitra) বৃহস্পতিবার (৫ জুন) সন্ধ্যায় সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ একটি পোস্টের মাধ্যমে প্রাক্তন বিজু জনতা দল (বিজেডি) সাংসদ পিনাকী মিশ্রর সঙ্গে তাঁর বিবাহের খবর নিশ্চিত করেছেন। এই পোস্টে তিনি একটি বিবাহের কেক কাটার ছবি শেয়ার করেছেন, যেখানে তাঁরা দুজন একসঙ্গে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। মহুয়া লিখেছেন, “সকলের ভালোবাসা ও শুভেচ্ছার জন্য ধন্যবাদ!! অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।” এই ঘোষণা রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
ছবিতে মহুয়া মৈত্রকে একটি গোলাপি বারাণসী সিল্ক শাড়িতে দেখা গেছে, যা সোনালি জরির কাজে সজ্জিত। তিনি ঐতিহ্যবাহী সোনার গয়না, যেমন চোকার নেকলেস, ঝুমকো, এবং মাথায় মাং টিকা পরেছেন। তাঁর সূক্ষ্ম মেকআপ এবং মাঝখানে সিঁথি করা চুল তাঁর লুককে আরও মার্জিত করেছে। অন্যদিকে, পিনাকী মিশ্র একটি হালকা পীচ রঙের নেহরু জ্যাকেট এবং ঐতিহ্যবাহী কুর্তা পরেছেন, যা এই উৎসবমুখর অনুষ্ঠানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এর আগেও তাঁদের একই পোশাকে হাত ধরে হাসিমুখে দাঁড়ানোর একটি ছবি প্রকাশিত হয়েছিল, যা সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়।
মহুয়া মৈত্র: একজন বিনিয়োগ ব্যাঙ্কার থেকে রাজনীতিবিদ
১২ অক্টোবর ১৯৭৪ সালে অসমে জন্মগ্রহণকারী মহুয়া মৈত্র একজন প্রাক্তন বিনিয়োগ ব্যাঙ্কার, যিনি বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগর থেকে দ্বিতীয় মেয়াদে সাংসদ। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের মাউন্ট হলিয়োক কলেজ থেকে অর্থনীতি ও গণিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন, যেখানে তিনি ম্যাগনা কাম লাউডে সম্মান পেয়েছেন। ২০১০ সালে মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার আগে তিনি জেপি মরগানের নিউইয়র্ক ও লন্ডন শাখায় বিনিয়োগ ব্যাঙ্কার হিসেবে কাজ করেছেন।
২০১৯ সালে মহুয়া করিমপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে প্রথম নির্বাচিত হন এবং পরে কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্র থেকে ২০১৯ ও ২০২৪ সালে জয়ী হন। তাঁর সংসদীয় বক্তৃতা, বিশেষ করে “ফ্যাসিবাদের সাতটি লক্ষণ” বিষয়ে বক্তৃতা, তাঁকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মনোযোগ এনে দেয়। তিনি বিজেপি-শাসিত কেন্দ্রীয় সরকারের কট্টর সমালোচক হিসেবে পরিচিত। তবে, ২০২৩ সালে “ক্যাশ-ফর-কোয়েরি” মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, যার ফলে তিনি ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে লোকসভা থেকে বহিষ্কৃত হন। অভিযোগে বলা হয়, তিনি ব্যবসায়ী দর্শন হিরানন্দানীর কাছ থেকে নগদ ও উপহার নিয়ে সংসদে প্রশ্ন তুলেছিলেন। মহুয়া এই অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং ২০২৪ সালে ৫৬,০০০ ভোটের ব্যবধানে পুনরায় জয়ী হয়ে ফিরে আসেন।
মহুয়া এর আগে ডেনিশ ফিনান্সিয়ার লারস ব্রোরসনের সঙ্গে বিবাহিত ছিলেন, যিনি তাঁর প্রথম স্বামী। তিনি সামাজিক মাধ্যমে নিজেই এই বিবাহ এবং পরবর্তী বিচ্ছেদের কথা নিশ্চিত করেছেন। এছাড়া, তিনি আইনজীবী জয়ীয়ান্ত দেহাদ্রাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কে ছিলেন, যিনি পরে “ক্যাশ-ফর-কোয়েরি” মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন।
Thank you everyone for the love and good wishes!! So grateful pic.twitter.com/hbkPdE2X7z
— Mahua Moitra (@MahuaMoitra) June 5, 2025
পিনাকী মিশ্র: একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী
২৩ অক্টোবর ১৯৫৯ সালে ওডিশার পুরীতে জন্মগ্রহণকারী পিনাকী মিশ্র একজন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এবং প্রাক্তন সাংসদ। তিনি দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজ থেকে ইতিহাসে স্নাতক এবং দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদ থেকে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন কংগ্রেসের হয়ে, ১৯৯৬ সালে পুরি লোকসভা আসন থেকে জয়ী হয়ে। পরে তিনি বিজেডিতে যোগ দেন এবং ২০০৯, ২০১৪, এবং ২০১৯ সালে একই আসন থেকে নির্বাচিত হন।
পিনাকী মিশ্র সংসদের অর্থ সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি, ব্যবসায়িক পরামর্শক কমিটি, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরামর্শদাতা কমিটি, এবং আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের পরামর্শদাতা কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি এর আগে সঙ্গীতা মিশ্রর সঙ্গে বিবাহিত ছিলেন, যিনি তাঁর প্রথম স্ত্রী, এবং তাঁদের দুটি সন্তান রয়েছে।
২০২৩ সালে “ক্যাশ-ফর-কোয়েরি” মামলায় পিনাকী মিশ্রর নামও উঠেছিল, যখন বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে দর্শন হিরানন্দীর হলফনামার উল্লেখ করে মহুয়া মৈত্র ও পিনাকীর “ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক” নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। পিনাকী এই অভিযোগকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন।
বিবাহ ও রাজনৈতিক আলোচনা
মহুয়া মৈত্র ও পিনাকী মিশ্রের এই বিবাহ ৩ মে বা ৩০ মে, ২০২৫ জার্মানির বার্লিনে একটি গোপন অনুষ্ঠানে সম্পন্ন হয়েছে বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এই দুই প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের মিলন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে একটি বিরল ব্যক্তিগত সংযোগ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তৃণমূল সাংসদ সায়োনি ঘোষ এক্স-এ তাঁদের অভিনন্দন জানিয়ে লিখেছেন, “অভিনন্দন এমএম ও পিএম… মহুয়া মৈত্র, পিনাকী মিশ্র, আপনাদের জন্য ভালোবাসা ও হাসির জীবন কামনা করি!” কংগ্রেস সাংসদ শশী থারুরও তাঁদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
তবে, সামাজিক মাধ্যমে এই বিবাহ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কিছু ব্যবহারকারী তাঁদের বয়সের পার্থক্য (৫০ ও ৬৫) এবং পূর্ববর্তী “ক্যাশ-ফর-কোয়েরি” মামলার প্রসঙ্গ তুলে সমালোচনা করেছেন। এক্স-এ একটি পোস্টে বলা হয়েছে, “মহুয়া মৈত্রর বিয়ে কেবল ভালোবাসা নয়, এটি রাজনৈতিক অভিজনদের একটি চুক্তি।” তবে মহুয়ার সমর্থকরা তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন।
মহুয়া মৈত্র ও পিনাকী মিশ্রের এই বিবাহ ভারতীয় রাজনীতির একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা, যা তাঁদের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনের মিলনকে তুলে ধরে। তাঁদের গোপনীয়তা বজায় রাখার সিদ্ধান্ত তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনকে জনসমক্ষে আলোচনার থেকে দূরে রাখার প্রচেষ্টা প্রতিফলিত করে। তবে, তাঁদের রাজনৈতিক প্রভাব এবং অতীত বিতর্ক এই ঘটনাকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে।