মুসলিম-খ্রিষ্টানদের SC সার্টিফিকেট বাতিল! মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা ঘিরে চাঞ্চল্য

মহারাষ্ট্রে বড়সড় প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নভিস ঘোষণা করেছেন, মুসলিম ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের দেওয়া সকল Scheduled Caste (SC) সার্টিফিকেট (SC Certificates) বাতিল করা হবে। এই…

Maharashtra CM Fadnavis Announces Cancellation of Muslim, Christian SC Certificates, Sparks Debate

মহারাষ্ট্রে বড়সড় প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নভিস ঘোষণা করেছেন, মুসলিম ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের দেওয়া সকল Scheduled Caste (SC) সার্টিফিকেট (SC Certificates) বাতিল করা হবে। এই ঘোষণার জেরে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে তুমুল বিতর্ক, যার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে রাজনৈতিক মহল থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন স্তরে। সংবিধানের ১৯৫০ সালের আদেশকে ভিত্তি করেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে দাবি মুখ্যমন্ত্রীর।

কী বলছে সংবিধান?
সংবিধানের (Scheduled Castes) আদেশ, ১৯৫০-এর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, শুধুমাত্র হিন্দু, বৌদ্ধ ও শিখ ধর্মাবলম্বীরাই SC হিসেবে স্বীকৃত হতে পারেন। কারণ, ঐতিহাসিকভাবে এই ধর্মগুলিতে জাতিভেদ এবং অস্পৃশ্যতার অস্তিত্ব ছিল। মুসলিম ও খ্রিষ্টান ধর্মে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিভেদ না থাকায়, এই সম্প্রদায়গুলিকে SC সুবিধা দেওয়া সংবিধানের মূল ভাবনার পরিপন্থী বলে দাবি প্রশাসনের।

   

যদিও বাস্তব পরিস্থিতিতে বহু মুসলিম ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষ সমাজের নীচু শ্রেণির অন্তর্গত এবং পিছিয়ে পড়া অবস্থায় রয়েছেন। তাই অনেকেই যুক্তি দিয়েছেন, এই সিদ্ধান্ত বাস্তব পরিস্থিতি না বুঝেই নেওয়া হয়েছে।

মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য
দেবেন্দ্র ফড়নভিস বলেন, “SC সুবিধার অপব্যবহার চলছে। বহু ব্যক্তি ধর্মান্তরিত হয়ে এই সার্টিফিকেট নিয়ে সরকারি সুযোগ নিচ্ছেন। এটা সংবিধান ও সামাজিক ন্যায়ের পরিপন্থী। মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের মধ্যে SC সার্টিফিকেটধারীদের শনাক্ত করে তা বাতিল করা হবে।” তিনি আরও বলেন, এটি কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে নয় বরং সংবিধান অনুযায়ী একটি “প্রশাসনিক সংশোধন”।

ফড়নভিসের মতে, বহু ক্ষেত্রে “কনভার্সন মাফিয়া” সক্রিয়ভাবে হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করছে এবং পরে তারা নিজেদের আগের জাতিসত্তা দেখিয়ে SC সুবিধা নিচ্ছে। এই ব্যবস্থার অবসান হওয়া উচিত।

বিরোধীদের প্রতিক্রিয়া
এই ঘোষণার পর তীব্র প্রতিবাদে সরব হয়েছে বিরোধীরা। কংগ্রেস, এনসিপি, তৃণমূল কংগ্রেস সহ একাধিক দল একে ‘ধর্মীয় বৈষম্য’ বলে আখ্যা দিয়েছে।

কংগ্রেস নেতা তথা লোকসভা সাংসদ শশী থারুর বলেছেন, “সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া ব্যক্তিদের ধর্ম দেখে নয়, বাস্তব অবস্থা দেখে সাহায্য করা উচিত। এটি সংবিধানের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন।”
অসদুদ্দিন ওয়াইসিও কড়া ভাষায় বলেন, “এই সিদ্ধান্ত মুসলিম এবং খ্রিষ্টান সম্প্রদায়কে সামাজিকভাবে আরও পিছিয়ে দেবে। এটি একটি পরিকল্পিত বিভাজনমূলক রাজনীতি।”

মুসলিম ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের উদ্বেগ
এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। বহু বছর ধরে যারা SC সার্টিফিকেটের সাহায্যে শিক্ষায় ও চাকরিতে সুযোগ পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অনিশ্চয়তা ও ভয় কাজ করছে।
এক মুসলিম তরুণীর বক্তব্য, “আমার পরিবার বিগত তিন প্রজন্ম ধরে মেথর সম্প্রদায়ভুক্ত। ধর্মান্তরিত হলেও আমাদের সামাজিক অবস্থান বদলায়নি। তাহলে কেন আমাদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হবে?”

Advertisements

বৌদ্ধ ও শিখদের নিয়ে প্রশ্ন
বহু মানুষ প্রশ্ন তুলেছেন, যখন বৌদ্ধ ও শিখ ধর্মজাতরা জাতিভেদবিরোধী ধর্মের অনুসারী, তখন তাঁদের SC সুবিধা দেওয়া হচ্ছে কেন? সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই দুটি ধর্মের সঙ্গে ভারতীয় জাতিভবনা ঐতিহাসিকভাবে যুক্ত, এবং ধর্মান্তরের পরেও জাতিগত বৈষম্যের শিকার হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।

আদালতে যেতে পারে বিষয়টি
এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে বেশ কয়েকটি সংগঠন শীঘ্রই সুপ্রিম কোর্টে যেতে চলেছে। তারা যুক্তি দিচ্ছে, ধর্মান্তরের পরেও অনেক মানুষ ঐতিহ্যগত পেশা ও সামাজিক বঞ্চনার শিকার, ফলে তাঁদের SC সুবিধা কেড়ে নেওয়া অসাংবিধানিক।

আইনি মহলেও এই সিদ্ধান্তের স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেক আইনজীবীর মতে, এটি একটি ‘কেস বাই কেস’ ভিত্তিতে বিচার হওয়া উচিত ছিল, না যে কোনো ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে সার্বিকভাবে বাতিল।

ভবিষ্যতের প্রভাব
এই পদক্ষেপের পর, মহারাষ্ট্রে বহু মানুষ সরকারি চাকরি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও রিজার্ভেশনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে এই সিদ্ধান্ত বিজেপি’র জাতপাতভিত্তিক ভোটব্যাংক কৌশল বলেও মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

বহুজন আন্দোলনের নেতা ও সমাজকর্মীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, এটি সামাজিক বৈষম্য আরও বাড়াবে। আবার অনেকে এটিকে SC সংরক্ষণের প্রকৃত উপকারভোগীদের রক্ষা করার সিদ্ধান্ত বলেও মানছেন।

মহারাষ্ট্র সরকারের এই পদক্ষেপ ভারতীয় রাজনীতিতে এক নতুন বিতর্কের সূত্রপাত করেছে। এটি সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে স্পর্শকাতর সামাজিক ও ধর্মীয় প্রশ্নগুলির একটি—ধর্মান্তরের পরেও একজন ব্যক্তির জাতিগত পরিচয় ও সামাজিক অবস্থান কীভাবে নির্ধারিত হবে। এই সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত সমাজে সাম্য ও ন্যায় আনবে, না কি নতুন বিভাজন তৈরি করবে, তা সময়ই বলবে। তবে এটুকু স্পষ্ট—এই ইস্যু জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে চলেছে।