মহারাষ্ট্র: ভারতের মাওবাদী বিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় রচিত হল মহারাষ্ট্রে। গড়চিরোলি জেলার ভামরাগড় অঞ্চলে ৬১ জন মাওবাদী পুলিশের সামনে আত্মসমর্পণ করেছেন, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন সংগঠনের অন্যতম শীর্ষ নেতা মল্লোজুলা বেনুগোপাল রাও, ওরফে ‘ভূপতি’ বা ‘সোনু ভূপতি’। ৬০ লক্ষ টাকার পুরস্কারপ্রাপ্ত এই নেতা দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে মাওবাদী সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও পলিটব্যুরোর গুরুত্বপূর্ণ মুখ ছিলেন।
দীপাবলির আগে চণ্ডীগড়ে পনির ও খোয়ার নমুনা জব্দ, ভেজাল চেনার উপায় জানুন
এই ঘটনাকে মহারাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মাওবাদী আত্মসমর্পণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। মঙ্গলবার রাতে ফোড়েওয়াড়া গ্রামে (ভামরাগড়) আত্মসমর্পণের ঘটনাটি ঘটে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আত্মসমর্পণকারী দলে ছিলেন দু’জন স্টেট জোনাল কমিটির সদস্য, দশজন ডিভিশনাল কমিটির সদস্য এবং পিপলস লিবারেশন গেরিলা আর্মি (পিএলজিএ)-র একাধিক সশস্ত্র জঙ্গি। তাঁরা পুলিশের সামনে ৫৪টি আগ্নেয়াস্ত্র জমা দিয়েছেন, যা এই অভিযানের তাৎপর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
এই ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয় গড়চিরোলি পুলিশ সদর দফতরে, মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিসের উপস্থিতিতে। তিনি আত্মসমর্পণকারী মাওবাদীদের হাতে ভারতের সংবিধানের কপি তুলে দিয়ে বলেন, “এটি শুধু একটি আত্মসমর্পণ নয়, এটি এক নতুন সূচনা। আমাদের লক্ষ্য হল গড়চিরোলিকে ‘স্টিল সিটি’-তে রূপান্তর করা, যেখানে শান্তি, উন্নয়ন ও প্রগতির মেলবন্ধন ঘটবে।”
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ঘোষিত ‘২০২৬ সালের মধ্যে নকশাল-মুক্ত ভারত’-এর লক্ষ্যের পথে এক বড় পদক্ষেপ নেওয়া হল বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে মহারাষ্ট্র ও ছত্তিশগড় সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ধারাবাহিকভাবে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে মাওবাদী সংগঠনের শক্তি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। ভূপতির মতো বর্ষীয়ান নেতা পর্যন্ত আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেওয়া এই প্রভাবেরই প্রমাণ।
পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে অনেকেই দীর্ঘদিন জঙ্গলে সক্রিয় ছিলেন এবং বিভিন্ন নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। তাঁদের পুনর্বাসনের জন্য রাজ্য সরকার বিশেষ পরিকল্পনা নিয়েছে। আত্মসমর্পণকারীদের সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী ফড়নবিস।
ভূপতি, যিনি একসময় অভুজমাড়হ অঞ্চলে মাওবাদীদের সামরিক শক্তি নিয়ন্ত্রণ করতেন, তাঁর আত্মসমর্পণকে বিশ্লেষকরা “মাওবাদী আন্দোলনের মানসিক ভাঙন” বলে বর্ণনা করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গলের জীবনে ক্লান্ত, ক্রমশ কমে আসা অর্থ ও রসদের জোগান, এবং নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে সংগঠনের ভাঙন—এই সমস্ত কারণেই ভূপতির মতো নেতারা এখন মূলধারায় ফিরে আসছেন।
মহারাষ্ট্রের গড়চিরোলি অঞ্চল একসময় মাওবাদী আন্দোলনের অন্যতম দুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলিতে রাস্তা, স্কুল, হাসপাতাল, এবং শিল্পক্ষেত্রে উন্নয়নমূলক প্রকল্প শুরু হওয়ায় সাধারণ মানুষও মাওবাদীদের প্রতি আস্থা হারাতে শুরু করেছেন। সরকারের উন্নয়নমূলক উদ্যোগ এবং পুলিশের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিই আত্মসমর্পণের সংখ্যাবৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন প্রশাসনের আধিকারিকরা।
নিরাপত্তা বাহিনী এই আত্মসমর্পণকে মাইলফলক হিসেবে দেখছে। তাদের বক্তব্য, “একজন মাওবাদী আত্মসমর্পণ মানে শুধু একটি অস্ত্র নামানো নয়, বরং হিংসা থেকে থেকে মানবতার দিকে এক বড় পদক্ষেপ।” সবমিলিয়ে, গড়চিরোলির এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ভারতের মাওবাদী বিরোধী অভিযানে নতুন দিগন্ত খুলে গেল। সরকারের লক্ষ্য এখন—এই পরিবর্তনের গতি আরও ত্বরান্বিত করা, যাতে ‘নকশাল-মুক্ত ভারত’-এর স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পায়।