কেরলে ভর করে সীতারামের চেয়ারে এমএ বেবি

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) বা CPIM-এর ২৪তম কংগ্রেসে প্রবীণ নেতা এবং পলিটব্যুরো সদস্য এমএ বেবি নতুন সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। এই কংগ্রেস বর্তমানে তামিলনাড়ুর…

MA Baby Appointed CPIM General Secretary at 24th Party Congress in Madurai

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) বা CPIM-এর ২৪তম কংগ্রেসে প্রবীণ নেতা এবং পলিটব্যুরো সদস্য এমএ বেবি নতুন সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। এই কংগ্রেস বর্তমানে তামিলনাড়ুর মাদুরাইয়ে চলছে। পলিটব্যুরো এমএ বেবির উত্থানের প্রস্তাব অনুমোদন করার পর, তিনি কেরলের দ্বিতীয় নেতা হিসেবে এই পদে অধিষ্ঠিত হলেন। এর আগে কিংবদন্তি নেতা ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদ এই দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাতও কেরলের বাসিন্দা হলেও, তিনি দিল্লি ইউনিটের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন যখন তিনি এই পদে ছিলেন। ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদ অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই)-এর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ১৯৫৩-৫৪ এবং ১৯৫৫-৫৬ সালে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পরে তিনি ১৯৬২-৬৩ সালে সিপিআই-এর সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৭৮ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত সিপিআই(এম)-এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

   

সিপিআই(এম)-এর কেন্দ্রীয় কমিটি, যেখানে ৮৪ জন সদস্য রয়েছেন (একটি পদ বর্তমানে খালি), আনুষ্ঠানিকভাবে এমএ বেবির নিয়োগ অনুমোদন করেছে। পার্টি কংগ্রেসের শেষ দিনগুলোতে এই ঘোষণা করা হয়। ৫ এপ্রিল ৭২ বছর বয়সে পা দেওয়া এমএ বেবি কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের পর সিপিআই(এম)-এর সবচেয়ে প্রবীণ নেতা। তবে তাঁর নির্বাচন প্রক্রিয়া বিনা বাধায় হয়নি।

সূত্রের খবর, পলিটব্যুরোর পাঁচজন সদস্য তাঁর উত্থানের বিরোধিতা করেছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের নেতা সূর্যকান্ত মিশ্র, নীলোৎপল বসু, মহম্মদ সেলিম এবং রামচন্দ্র ডোম, এবং মহারাষ্ট্রের অশোক ধাওয়ালে। এই অভ্যন্তরীণ বিরোধ সত্ত্বেও, প্রকাশ কারাত কেবলমাত্র এমএ বেবিকেই সাধারণ সম্পাদকের পদে সমর্থন করেছিলেন বলে জানা গেছে।

একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপে, পার্টি ৭৫ বছরের বয়সসীমা নিয়ম শিথিল করেছে। এর ফলে প্রবীণ নেতা পি.কে. শ্রীমতি এবং মহম্মদ ইউসুফ তারিগামি কেন্দ্রীয় কমিটিতে থাকতে পারবেন। একইভাবে, ৭৯ বছর বয়সী মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নকে পলিটব্যুরোতে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

নতুন নির্বাচিত পলিটব্যুরোতে রয়েছেন মরিয়ম ধাওয়ালে, জিতেন্দ্র চৌধুরী, আমরা রাম, বিজু কৃষ্ণন, অরুণ কুমার, শ্রীদীপ ভট্টাচার্য, ইউ ভাসুকি এবং কে বালাকৃষ্ণন। ভাসুকি এবং বালাকৃষ্ণনের অন্তর্ভুক্তির ফলে তামিলনাড়ু এখন পলিটব্যুরোতে দুজন প্রতিনিধি পেয়েছে। প্রাক্তন পলিটব্যুরো সদস্য প্রকাশ কারাত, বৃন্দা কারাত এবং মানিক সরকারকে বিশেষ আমন্ত্রিত হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, সাংবাদিক থেকে রাজনীতিবিদ হওয়া রাজ্যসভার সাংসদ জন ব্রিটাসও কেন্দ্রীয় কমিটিতে বিশেষ আমন্ত্রিত হিসেবে যোগ দিয়েছেন।

এদিকে, একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনায়, মহারাষ্ট্রের প্রবীণ নেতা ডিএল কারাদ, যিনি সিআইটিইউ-এর রাজ্য সভাপতি, কেন্দ্রীয় কমিটির একটি আসনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তবে তিনি মাত্র ৩১টি ভোট পেয়েছেন। গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কারাদ জানান, তিনি সহকর্মীদের অনুরোধে গণতান্ত্রিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য প্রার্থী হয়েছিলেন। ফলাফল তাঁর কাছে বড় বিষয় নয় বলেও তিনি জানান।

এমএ বেবির পটভূমি

এমএ বেবি, যিনি মরিয়ম আলেকজান্ডার বেবি নামেও পরিচিত, কেরলের কোল্লাম জেলার প্রাক্কুলামে ১৯৫৪ সালের ৫ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন এবং স্টুডেন্টস ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া (এসএফআই)-এর মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করেন। পরে তিনি ডেমোক্রেটিক ইয়ুথ ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া (ডিওয়াইএফআই)-এর সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত তিনি রাজ্যসভার সাংসদ ছিলেন এবং ২০০৬ সালে ভি.এস. আচুতানন্দনের মন্ত্রিসভায় শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

Advertisements

পশ্চিমবঙ্গে বিরোধিতার প্রেক্ষাপট

এমএ বেবির নির্বাচনের বিরোধিতা পশ্চিমবঙ্গ ইউনিট থেকে উঠে এসেছে, যেখানে একদল নেতা অশোক ধাওয়ালেকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। ধাওয়ালে অল ইন্ডিয়া কিষান সভার সভাপতি এবং পলিটব্যুরো সদস্য। পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এম)-এর প্রভাব কমে যাওয়ার পর থেকে এই ইউনিট কেরলের আধিপত্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তবে শেষ পর্যন্ত বেবির পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় তাঁর নির্বাচন নিশ্চিত হয়।

পার্টির ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ

এমএ বেবির নেতৃত্বে সিপিআই(এম)-এর সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। গত বছর সীতারাম ইয়েচুরির মৃত্যুর পর পার্টির শীর্ষ পদ খালি হয়ে যায়। এরপর প্রকাশ কারাত অন্তর্বর্তীকালীন সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। কেরল এবং পশ্চিমবঙ্গে ২০২৬ সালে বিধানসভা নির্বাচন আসছে। এই দুই রাজ্যে পার্টির সংগঠনকে শক্তিশালী করা এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব মেটানো বেবির প্রথম কাজ হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বেবির সামনে জাতীয় স্তরে পার্টির প্রভাব বাড়ানোর চ্যালেঞ্জও রয়েছে। কেরলে পার্টি এখনও শক্তিশালী হলেও, পশ্চিমবঙ্গে এর প্রভাব অনেকটাই কমে গেছে। ত্রিপুরাতেও পার্টি ক্ষমতা হারিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বেবির নেতৃত্বে পার্টি কীভাবে নিজেকে পুনরুজ্জীবিত করে, সেটাই দেখার বিষয়।

এমএ বেবির নির্বাচন সিপিআই(এম)-এর জন্য একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা। তাঁর অভিজ্ঞতা এবং বৌদ্ধিক গভীরতা পার্টির ভবিষ্যৎ গড়তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে অভ্যন্তরীণ ঐক্য এবং জাতীয় রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখা তাঁর কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হবে। পশ্চিমবঙ্গের বিরোধিতা সত্ত্বেও তাঁর নির্বাচন প্রমাণ করে যে, কেরল ইউনিট এখনও পার্টির নেতৃত্বে প্রভাবশালী।