জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়েে ২২ এপ্রিল সংঘটিত ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় (Pahalgam Terror Attack) ২৬ জন পর্যটক নিহত হওয়ার পর বুধবার (২৩ এপ্রিল) রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে জনতা রাস্তায় নেমে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। রাজনৈতিক দল, ব্যবসায়ী সংগঠন, এবং সামাজিক-ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলি একযোগে এই নৃশংস হামলার নিন্দা করেছে এবং একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে: ‘আমাদের নামে নয়’। এই হামলা, যা ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলার পর কাশ্মীর উপত্যকার সবচেয়ে মারাত্মক জঙ্গি ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, জনমনে গভীর ক্ষোভ ও শোকের সৃষ্টি করেছে।
লাল চকে ঘণ্টাঘরে সমবেত প্রতিবাদ
শ্রীনগরের লাল চকের ঐতিহাসিক ঘণ্টাঘর, যা জম্মু ও কাশ্মীরের অশান্ত ইতিহাসে বহু আন্দোলন ও প্রতিবাদের সাক্ষী, এই দিন নিরীহ পর্যটকদের হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ন্যাশনাল কনফারেন্স থেকে পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (পিডিপি)-সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের নিজ নিজ কার্যালয় থেকে মিছিল বের করে, যা ঘণ্টাঘরে এসে সমবেত হয়। এই মিছিলে যোগ দেয় বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও নাগরিক সমাজের সংগঠন, যারা শান্তিপূর্ণভাবে ধর্নায় বসে। বরমুল্লা, কুপওয়াড়া, অনন্তনাগ, গান্দেরবালসহ উপত্যকার বিভিন্ন স্থানে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে সাধারণ মানুষ নিরীহ মানুষের হত্যার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে।
শ্রীনগরের বাসিন্দা হাজি বশির আহমদ দার বলেন, “এই ধরনের ঘটনা কাশ্মীরের নামে বা ইসলামের নামে হওয়া উচিত নয়। ইসলামী শিক্ষা মানুষের জীবনের মূল্য দেয়, এবং একজন নিরীহ মানুষের জীবন নেওয়া সমগ্র মানবতার হত্যার সমান।” তিনি আরও বলেন, “আমরা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এবং শান্তির পক্ষে। এই হামলা আমাদের পরিচয়ের বিরুদ্ধে।”
বৈসরন উপত্যকায় নৃশংস হামলা
পহেলগাঁওয়েের বৈসরন উপত্যকার পাইন বন থেকে ছদ্মবেশী জঙ্গিরা বেরিয়ে এসে সেখানে পনি রাইড এবং পিকনিক উপভোগ করা পর্যটকদের উপর অতর্কিত গুলি চালায়। এই হামলায় ২৫ জন ভারতীয় পর্যটক, একজন নেপালি নাগরিক এবং দুইজন স্থানীয় বাসিন্দা নিহত হন। হামলার দায় স্বীকার করেছে লস্কর-ই-তৈয়বার সঙ্গে যুক্ত ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ)। এই ঘটনা কাশ্মীরের পর্যটন শিল্পের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে, যা অঞ্চলের অর্থনীতির মূল স্তম্ভ।
সরকারের পদক্ষেপ ও প্রতিশ্রুতি
জম্মু ও কাশ্মীর সরকার হামলায় নিহত প্রত্যেকের পরিবারের জন্য ১০ লক্ষ টাকার ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছে। এছাড়া, মন্ত্রিসভা লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনোজ সিনহাকে ২৮ এপ্রিল সকাল ১০:৩০-এ জম্মুতে বিধানসভার একটি বিশেষ অধিবেশন ডাকার পরামর্শ দিয়েছে। সরকারের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, “মন্ত্রিসভা এই বর্বরোচিত হামলায় নিরীহ জীবনের ক্ষতি এবং আহতদের জন্য গভীর শোক ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। এই অমানবিক জঙ্গি কাজের তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে, যা জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষের শান্তি, ঐক্য এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপর সরাসরি আঘাত।”
সরকার ভুক্তভোগী পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। মুখপাত্র আরও বলেন, “মন্ত্রিসভা এই জঘন্য কাজের অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে এবং প্রত্যেক নাগরিকের জীবন ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেছে।” জম্মু ও কাশ্মীরের সরকারি কর্মচারী, হাইকোর্ট, এবং জম্মু ও কাশ্মীর ব্যাঙ্ক পৃথক শোকসভা করে এবং ভুক্তভোগীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে দুই মিনিট নীরবতা পালন করে।
উপত্যকায় বনধ, বন্ধ ব্যবসা
বুধবার উপত্যকায় বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল এবং সংগঠনের ডাকে সম্পূর্ণ বনধ পালিত হয়। শ্রীনগর এবং কাশ্মীরের অন্যান্য এলাকায় অধিকাংশ দোকান, জ্বালানি স্টেশন এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। জনসাধারণের যানবাহন খুবই কম ছিল, এবং বেসরকারি স্কুলগুলি বন্ধ রাখা হয়। কুলগামে একটি প্রতিবাদে ফল চাষি জিএম বান্দে বলেন, “সরকারের উচিত সন্ত্রাসের এই বিপদ দূর করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া, যাতে বৈসরনের মতো ঘটনা আর না ঘটে। কাশ্মীরের মানুষ সবসময় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ছিল। তবে, কাশ্মীরি সম্প্রদায়কে বদনাম করতে এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে আঘাত করার জন্য ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। এই ধরনের কাজ স্থানীয়দের জীবিকার উপর প্রভাব ফেলে।”
কুপওয়াড়ার হান্দওয়ারা শহরে প্রতিবাদকারীদের মধ্যে থাকা সমাজকর্মী তৌসিফ আহমদ ওয়ার বলেন, “আমরা এখানে প্রতিবাদ করছি বিশ্বের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিতে যে কাশ্মীরিরা সন্ত্রাসের সঙ্গে নেই। আমরা পহেলগাঁওয়েে পর্যটকদের উপর হামলার তীব্র নিন্দা জানাই।”
জম্মু অঞ্চলে পাকিস্তান-বিরোধী প্রতিবাদ
জম্মু অঞ্চলে মূলধারার রাজনৈতিক দল এবং ধর্মীয় সংগঠনগুলি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ সংগঠিত করে। জম্মু চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, জম্মু বার অ্যাসোসিয়েশন, অল জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর ট্রান্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন, জম্মু ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন, শিব সেনা দোগরা ফ্রন্ট এবং রাষ্ট্রীয় বজরং দলের মতো সংগঠনগুলি এই প্রতিবাদে অংশ নেয়। দোদা, কিশতওয়ার, রিয়াসি, কাটরা, উধমপুর, কাঠুয়া, সাম্বা, বানিহাল, রামবান, পুঞ্চ এবং রাজৌরিতে একই ধরনের প্রতিবাদ অনুষ্ঠিত হয়।
পর্যটন শিল্পে প্রভাব
পহেলগাঁওয়ে হামলা কাশ্মীরের পর্যটন শিল্পের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। হামলার পর ফ্লাইট বাতিলের সংখ্যা সাত গুণ বেড়েছে, এবং ভবিষ্যতের বুকিং ৪০ শতাংশ কমে গেছে। এয়ার ইন্ডিয়া এবং ইন্ডিগো পর্যটকদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনার জন্য অতিরিক্ত ফ্লাইট পরিচালনা করেছে। স্থানীয় হোটেল মালিক এবং দোকানদাররা প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নিয়ে পর্যটকদের জন্য বিনামূল্যে থাকার ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলা জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণের মধ্যে গভীর শোক এবং ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। ‘আমাদের নামে নয়’ স্লোগানে একত্রিত হয়ে রাজ্যের মানুষ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তাদের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান প্রকাশ করেছে। সরকার এবং নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এই সংকট মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই ঘটনা কাশ্মীরের শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলেও, জনগণের প্রতিরোধ এবং সরকারের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি আশার আলো জাগিয়েছে।