ভারতের চলচ্চিত্র জগতে ভাষা রাজনীতির (Hindi Language Controversy) নতুন অধ্যায় শুরু করলেন বলিউড অভিনেত্রী কাজল। সম্প্রতি মহারাষ্ট্রে এক মারাঠি চলচ্চিত্র পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে হিন্দি ভাষায় কথা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়ে কাজল বলেন, “আমি হিন্দি বলব না, যার বোঝার বুঝবে।” তাঁর এই বক্তব্য মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে ওঠে, তৈরি হয় চাঞ্চল্য এবং প্রবল বিতর্ক।
এই মন্তব্য ঘিরে প্রশ্ন উঠেছে ভাষা পরিচয়, সাংস্কৃতিক শ্রদ্ধা ও ব্যক্তিগত পছন্দের সীমারেখা নিয়ে। একই সঙ্গে এটি আবারও সামনে এনেছে ভারতের বহু ভাষাভাষী সমাজে ভাষাগত সংবেদনশীলতা এবং তার রাজনৈতিক তাৎপর্য।
🔷 ঘটনাস্থল ও প্রতিক্রিয়া
মহারাষ্ট্রের একটি সম্মানজনক মারাঠি চলচ্চিত্র পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে কাজল অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন। সেখানেই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথোপকথনের সময়, তাঁকে হিন্দিতে বক্তব্য রাখতে অনুরোধ করা হলে তিনি বলেন, “আমি হিন্দি বলব না। যার বোঝার বুঝবে।”
এই মন্তব্যকে কেউ দেখছেন তাঁর মাতৃভাষা মারাঠির প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন হিসেবে, আবার কেউ বলছেন, এই বক্তব্য হিন্দি ভাষার প্রতি বিদ্বেষের ইঙ্গিত বহন করে। বলিউডে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করার পর, এক জাতীয় ভাষার এমন এড়িয়ে চলা অনেকের কাছে প্রশ্নসাপেক্ষ।
🔷 সামাজিক মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া
সোশ্যাল মিডিয়ায় কাজলের বক্তব্য দুই ভাগে ভাগ করেছে নেটাগরিকদের। একদল তাঁকে বাহবা দিয়েছেন মাতৃভাষার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার জন্য, আবার অন্য একদল হিন্দি বিরোধিতার অভিযোগ তুলেছেন। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, “বলিউড যাঁর পরিচয় দিয়েছে, তিনি হিন্দিকে কেন এড়িয়ে গেলেন?”
একজন টুইটার ব্যবহারকারী লেখেন, “হিন্দি সিনেমায় কাজ করে খ্যাতি অর্জন করে এখন যদি আপনি বলেন ‘হিন্দি বলব না’, তাহলে সেটা আপনি যে শিল্পের মাধ্যমে নিজেকে গড়েছেন, তার অশ্রদ্ধা।” অন্যদিকে, অনেকেই বলছেন, “এটি কাজলের স্বাধীনতা। তিনি যে ভাষায় স্বচ্ছন্দ, সেই ভাষায় কথা বলার অধিকার তাঁর আছে। ভারত একটি বহুভাষিক দেশ, এখানে ভাষার বৈচিত্র্যই সৌন্দর্য।”
🔷 ভাষা ও রাজনৈতিক বাস্তবতা
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ভাষা এবং রাজনৈতিক বাস্তবতার দ্বন্দ্ব আবারও সামনে এসেছে। মহারাষ্ট্রে মারাঠি ভাষার গুরুত্ব বরাবরই প্রবল। রাজ্যের আঞ্চলিক দলগুলোও ভাষা প্রশ্নে তীব্র সংবেদনশীল। অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় স্তরে হিন্দিকে ‘জাতীয় ভাষা’ রূপে তুলে ধরার প্রবণতাও রয়েছে। ফলে হিন্দি ও আঞ্চলিক ভাষাগুলোর মধ্যে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংঘাত অনেক পুরনো।
এর আগেও দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে হিন্দির আধিপত্য রোধে বহুবার প্রতিবাদ হয়েছে। তামিলনাড়ু, কেরল, কর্ণাটক ও ওড়িশায় আঞ্চলিক ভাষার স্বীকৃতি ও মর্যাদা রক্ষার প্রশ্ন বারবার উঠেছে। কাজলের বক্তব্য যেন সেই দীর্ঘ ঐতিহ্যেরই নতুন রূপ।
🔷 বলিউডের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক
এই ঘটনার পর, বলিউডের ভূমিকা নিয়েও বিতর্ক শুরু হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, বলিউড কি আদতে হিন্দিভাষী সংস্কৃতিরই বাহক, না কি এটি একটি বহুভাষিক প্ল্যাটফর্ম? কাজল যদি মারাঠি ভাষা ব্যবহার করতে চান, তবে বলিউডের সহনশীলতা কোথায়?
চলচ্চিত্র বিশ্লেষক অনন্ত ভান্ডারকর বলেন, “ভাষা একটি সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব। একজন শিল্পী নিজস্ব ভাষায় কথা বলতেই পারেন, তাতে হিন্দি বা অন্য কোনো ভাষা অবমানিত হয় না। বরং এই বিতর্কই দেখিয়ে দেয়, আমরা ভাষাগত বৈচিত্র্যকে কতটা সহ্য করতে পারি।”
🔷 সাংস্কৃতিক দায়বদ্ধতা না স্বাধীনতা?
এই ঘটনায় বৃহত্তর প্রশ্ন উঠেছে—একজন তারকা কি কেবল নিজের পছন্দে কথা বলতে পারেন, না কি তাঁদের ওপর একটি সাংস্কৃতিক দায়ও থাকে? কাজল দীর্ঘদিন হিন্দি সিনেমায় কাজ করেছেন, তাঁর বিপুল হিন্দিভাষী ভক্তবৃন্দ রয়েছেন। এমন অবস্থায়, তাঁদের অনুভূতিও কি বিবেচনায় আসা উচিত ছিল?
অন্যদিকে, কারও স্বাধীন ভাষা বেছে নেওয়ার অধিকারও তো নস্যাৎ করা যায় না। এই দুই অবস্থানের সংঘাত থেকেই জন্ম নিচ্ছে ভাষা-রাজনীতির এই দ্বন্দ্ব।
“হিন্দি বলব না, যার বোঝার বুঝবে…”—এই ছোট বাক্যটি শুধু একটি ভাষা পছন্দের প্রতিফলন নয়, বরং তা ভারতের সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক বাস্তবতার গভীর চিত্র তুলে ধরেছে। কাজল যেমন নিজের অবস্থানে অবিচল, তেমনই ভাষা সংবেদনশীলতা নিয়েও সমাজে মতভেদ গভীর।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে একটাই বার্তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে—ভারতের ভাষা রাজনীতি এখনও অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং জটিল। ভাষা কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়, তা আত্মপরিচয়, সংস্কৃতি এবং গর্বের প্রতীক। তাই তার বেছে নেওয়া, কিংবা বর্জন করা—দুই-ই হয়ে ওঠে রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রতিক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দু।