লোকসভায় বিচারপতি যশোবন্ত বর্মার (Justice Yashwant Varma) বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব পেশ হওয়া এবং সেই প্রস্তাব স্পিকার ওম বিড়লার গ্রহণ করার ঘটনা সংসদীয় ও বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে উঠতে চলেছে। সোমবার এই প্রস্তাব লোকসভায় উপস্থাপন করা হয়। অভিযোগের ভিত্তিতে লোকসভার স্পিকার তা গ্রহণ করে পরবর্তী সাংবিধানিক প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। সাংবিধানিক নিয়ম অনুযায়ী, কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়া চালানোর জন্য সংসদের দুই কক্ষেরই সম্মতি ও নির্দিষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজন হয়।
প্রস্তাব গ্রহণ ও কমিটি গঠন
লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লা, প্রস্তাব গ্রহণের পাশাপাশি তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। এই কমিটি অভিযোগের সত্যতা যাচাই করবে এবং তার ভিত্তিতে রিপোর্ট পেশ করবে। সাধারণত, এই ধরনের কমিটিতে থাকেন একজন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, একজন হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং একজন বিশিষ্ট আইনজীবী বা সাংসদ। কমিটি সমস্ত প্রমাণ ও সাক্ষ্য পর্যালোচনা করবে এবং তদন্ত সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত বিচারপতি সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব পালন করলেও তার কার্যকলাপ গভীর পর্যবেক্ষণে থাকবে।
ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়ার সাংবিধানিক ধাপ
ভারতের সংবিধানের ১২৪(৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্টের কোনো বিচারপতিকে পদচ্যুত করতে হলে তাঁর বিরুদ্ধে প্রমাণিত অসদাচরণ বা অযোগ্যতার অভিযোগ থাকতে হবে। প্রথমে নির্দিষ্ট সংখ্যক সাংসদের স্বাক্ষরযুক্ত প্রস্তাব লোকসভা বা রাজ্যসভায় পেশ করতে হয়। এরপর স্পিকার বা চেয়ারম্যান তা গ্রহণ করলে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। কমিটি অভিযোগ প্রমাণিত করলে, সংসদের দুই কক্ষে প্রস্তাব পাস হতে হবে—এবং তা পাস হতে হবে বিশেষ সংখ্যাগরিষ্ঠতায়, অর্থাৎ উপস্থিত সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ এবং মোট সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার সমর্থনে। এরপর রাষ্ট্রপতি সেই বিচারপতিকে অপসারণের অনুমোদন দেন।
বিচারপতি যশোবন্ত বর্মার বিরুদ্ধে অভিযোগ
যদিও এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগের বিস্তারিত প্রকাশ পায়নি, সংসদ সূত্রে জানা যাচ্ছে যে, বিচারপতি যশোবন্ত বর্মার(Justice Yashwant Varma) বিরুদ্ধে গুরুতর প্রশাসনিক ও আর্থিক অনিয়ম, এবং কিছু ক্ষেত্রে রায়ের ক্ষেত্রে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগগুলির মধ্যে রয়েছে—আদালতের ক্ষমতার অপব্যবহার, ন্যায়বিচারের মানদণ্ড লঙ্ঘন এবং বিচারিক নৈতিকতার বিরোধী কর্মকাণ্ড।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
এই ঘটনায় রাজনৈতিক মহলেও সাড়া পড়েছে। বিরোধী শিবির বলছে, বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা বজায় রাখতে হলে এমন পদক্ষেপ অপরিহার্য। অন্যদিকে, কিছু নেতা অভিযোগ করেছেন, এই পদক্ষেপ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তাঁদের মতে, বিচারপতির দেওয়া কিছু রায়ের কারণে সরকার বিরক্ত হয়েছিল, আর তাই ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়া শুরু হলো।
আইন বিশেষজ্ঞদের মত
বেশ কিছু আইন বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, ইমপিচমেন্ট একটি অত্যন্ত গুরুতর সাংবিধানিক প্রক্রিয়া এবং এটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার হাতিয়ার হয়ে উঠলে বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা বিপন্ন হতে পারে। তবে, যদি অভিযোগগুলি সত্যি প্রমাণিত হয়, তবে বিচারিক নৈতিকতা ও জনগণের আস্থা রক্ষার জন্য এমন পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
আগামী দিনের পথ
এখন নজর থাকবে তদন্ত কমিটির কাজের দিকে। কমিটি প্রমাণ ও সাক্ষ্য সংগ্রহ করে একটি বিস্তারিত রিপোর্ট দেবে। সেই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই লোকসভা ও রাজ্যসভায় ভোটাভুটি হবে। এই প্রক্রিয়া কয়েক মাস পর্যন্ত চলতে পারে। শেষ পর্যন্ত, এই ঘটনার মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থার জবাবদিহিতা এবং সংসদের ভূমিকা—দুটোই বড় প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াবে।
সংসদ ও বিচার বিভাগের এই টানাপোড়েন ভবিষ্যতের জন্য একটি দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারে। যদি প্রমাণিত হয় যে, কোনো বিচারপতি সত্যিই অসদাচরণ করেছেন, তবে এটি হবে বিচার ব্যবস্থার জন্য একটি সতর্কবার্তা। আবার, যদি অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়, তবে এটি বিচারপতিদের স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হয়ে থাকবে।