আজকের বিশ্বে বিভিন্ন দেশের মানুষ একে অপরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করছে, এবং এই সংযোগ কখনও কখনও অপ্রত্যাশিতভাবে গভীর সম্পর্কে পরিণত হচ্ছে। এমনই একটি গল্প এসেছে জাপানের এক তরুণ শুন সাগারার। শুন সাগারা, যিনি জাপানের একটি পরিচিত উদ্যোক্তা (Japanese Entrepreneur) এবং জেনেসিয়া ভেঞ্চারস নামক বিনিয়োগ কোম্পানির ভারতীয় শাখার প্রধান, তিনি ব্যবসা প্রসারের জন্য টোকিও থেকে বাংলাদেশের প্রযুক্তি রাজধানী বেঙ্গালুরুতে চলে আসেন। কিন্তু এই পথচলা শুধু ব্যবসার জন্যই ছিল না; এর মাঝে তিনি ভারতের সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা এবং পরিবারের সঙ্গে একটি নতুন সংসার গড়ে তুলেছেন।
জাপান থেকে ভারতের দিকে যাত্রা
শুন সাগারার গল্প শুরু হয় ২০২৩ সালে, যখন তিনি জেনেসিয়া ভেঞ্চারসের পক্ষ থেকে ভারতের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমে বিনিয়োগের সম্ভাবনা দেখতে বেঙ্গালুরুতে পা রাখেন। জাপানের তুলনায় ভারতের অর্থনীতি তখন দ্রুত গতিতে বিকাশ লাভ করছিল, বিশেষ করে প্রযুক্তি ও স্টার্টআপ খাতে। তিনি বুঝতে পারেন যে ভারতের “জুগাড়” মানসিকতা এবং জাপানের “কাইজেন” (সবলীকরণ) দৃষ্টিভঙ্গি একত্রে কাজ করলে ব্যবসায়িক উদ্ভাবনের এক নতুন দ্বার খোলা যেতে পারে। এই ধারণা নিয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নেন ভারতের বাজারে ডুব দিতে।
তবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ ছিল না। তাঁর স্ত্রী প্রথমে এই পরিবর্তনের কথা শুনে সংশয় প্রকাশ করেন। দিল্লির বায়ুদূষণ এবং নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বেগ ছিল তাঁর মনে। কিন্তু শুন তাঁকে বোঝান যে বেঙ্গালুরু একটি সমৃদ্ধ স্টার্টআপ কেন্দ্র হিসেবে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি লাভ করেছে এবং এখানে পরিবার নিয়ে বসবাস করা সম্ভব। শেষ পর্যন্ত তাঁর স্ত্রী রাজি হন, এবং এই জাপানি দম্পতি ভারতের মাটিতে নতুন জীবন শুরু করেন।
বেঙ্গালুরুতে নতুন জীবন
বেঙ্গালুরুতে এসে শুন সাগারা তাঁর ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য সফল করার পাশাপাশি এই শহরের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি বলেন, “বেঙ্গালুরু আমার জন্য শুধু একটি কাজের জায়গা নয়, এটি একটি পরিবারের জন্য আদর্শ স্থান।” তাঁর দুটি সন্তান এখানে বড় হচ্ছে, এবং তিনি ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা ও সামাজিক পরিবেশের প্রশংসা করেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে জাপানের তুলনায় ভারতের মানুষের মধ্যে রয়েছে একটি উদ্ভাবনী মনোভাব, যা তাঁর ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তগুলোকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
শুনের স্ত্রীও এখন ভারতীয় খাবার এবং সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী। তিনি স্থানীয় বাজারে গিয়ে কেনাকাটা করতে পছন্দ করেন এবং তাঁর সন্তানরা বেঙ্গালুরুর আন্তর্জাতিক স্কুলে পড়াশোনা করছে। এই পরিবার জাপানী ও ভারতীয় সংস্কৃতির সমন্বয়ে তাদের জীবনযাত্রা গড়ে তুলেছে, যা তাদের জন্য একটি অনন্য অভিজ্ঞতা হয়ে উঠেছে।
🚨 I moved from Tokyo to Bengaluru to launch a VC office. I had to convince my wife, but now we love raising kids and working in India – a Japanese investor Shun Sagara.
(Business Insider) pic.twitter.com/G6bJJEliGW
— Indian Tech & Infra (@IndianTechGuide) August 5, 2025
>
ব্যবসায়িক সাফল্য ও ভারত-জাপান সম্পর্ক
শুন সাগারার ভারত প্রবেশ সুফল দিয়েছে। জেনেসিয়া ভেঞ্চারসের অধীনে তিনি ভারতের স্টার্টআপগুলোতে বিনিয়োগ করছেন, বিশেষ করে প্রযুক্তি ও স্মার্ট শহর প্রকল্পে। তিনি বিশ্বাস করেন যে ভারতের তরুণ প্রজন্ম এবং জাপানের উন্নত প্রযুক্তি একত্রে কাজ করলে এশিয়ার অর্থনীতিতে এক নতুন বিপ্লব আনা সম্ভব। ২০২৪ সালের ইনভেস্ট ইন্ডিয়ার রিপোর্ট অনুসারে, জাপান ভারতের পঞ্চম বৃহত্তম বিনিয়োগকারী দেশ, যার মোট বিদেশি সরকারি বিনিয়োগ (FDI) ৪২.৫৪ বিলিয়ন ডলার। এই পরিসংখ্যান শুনের সিদ্ধান্তের সঠিকতা প্রমাণ করে।
ভারত ও জাপানের মধ্যে ব্যবসায়িক সম্পর্ক আরও গাঢ় করার জন্য শুন স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কাজ করছেন। তিনি বলেন, “ভারতের ‘জুগাড়’ এবং জাপানের ‘কাইজেন’ একত্রে কাজ করলে আমরা বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা পাব।” এই দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে ভারতীয় স্টার্টআপগুলোর সঙ্গে নতুন নতুন প্রকল্পে জড়িত করেছে, যা ভবিষ্যতে উভয় দেশের জন্য লাভজনক হবে।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা
শুন সাগারা এখন ভারতেই দীর্ঘমেয়াদী ভবিষ্যৎ দেখছেন। তিনি পরিকল্পনা করছেন তাঁর সন্তানদের ভারতীয় ও জাপানী শিক্ষা ব্যবস্থার সমন্বয়ে লালন-পালন করা। তিনি আরও চান যে তাঁর কোম্পানি ভারতের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমে আরও গভীরভাবে অংশ নেয়। বেঙ্গালুরুকে তিনি “ভারতের সিলিকন ভ্যালি” হিসেবে দেখেন, যেখানে প্রযুক্তি ও সংস্কৃতি একত্রে ফলপ্রসূ ফল দিচ্ছে।
শুন সাগারার গল্প একটি উদাহরণ যে সীমানা পেরিয়ে মানুষ কীভাবে একে অপরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারে। ব্যবসা শুরু করতে এসে তিনি ভারতকে তাঁর দ্বিতীয় বাসস্থান হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এই জাপানি যুবকের ভারত প্রেম এবং তাঁর সংসার গড়ে তোলার কাহিনী আমাদের শিক্ষা দেয় যে সংস্কৃতির মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব, এবং এটি দুই দেশের মধ্যে বন্ধন আরও শক্ত করতে পারে। ভারত ও জাপানের এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, এবং শুন সাগারার মতো ব্যক্তিরা এই যাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।