ভারত ও জাপানের (Japan) মধ্যে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সহযোগিতার প্রেক্ষাপটে জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো)-র নির্বাহী উপদেষ্টা কাজুয়া নাকাজো ভারতে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের উন্নয়নে আরও বেশি অবদান রাখার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জাপান সফরের সময় তিনি বলেন, “আমরা ভারতে সেমিকন্ডাক্টর শিল্প গড়ে তুলতে আরও বেশি কাজ করতে পারি।
এবার প্রায় ১৫০টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়েছে। ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ সফরে প্রায় ৬০টি এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়েছিল, যা মূলত উৎপাদন ও ডিজিটাল খাতে কেন্দ্রীভূত ছিল। কিন্তু এবারের সহযোগিতা আরও বৈচিত্র্যময়। উদাহরণস্বরূপ, কিছু এমওইউ সেমিকন্ডাক্টর, কিছু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), কিছু কোয়ান্টাম প্রযুক্তি এবং কিছু মহাকাশ খাতে।
এটি উন্নত প্রযুক্তির ক্ষেত্রে শক্তিশালী সাপ্লাই চেইন গড়ে তোলার বৈশ্বিক প্রবণতাকে প্রতিফলিত করে।” এই বক্তব্য ভারত ও জাপানের মধ্যে কৌশলগত অংশীদারিত্বের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
২০২৫ সালের আগস্টে প্রধানমন্ত্রী মোদীর জাপান সফরের সময় ভারত ও জাপানের মধ্যে সেমিকন্ডাক্টর, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোয়ান্টাম প্রযুক্তি, পরিচ্ছন্ন শক্তি এবং মহাকাশ খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য একাধিক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। ভারতের ইলেকট্রনিক্স ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং জাপানের অর্থনীতি, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সেমিকন্ডাক্টর সাপ্লাই চেইন শক্তিশালী করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
এই চুক্তির ফলে জাপানের শীর্ষস্থানীয় সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানি রেনেসাস ইলেকট্রনিক্স গুজরাটে সিজি পাওয়ারের সঙ্গে একটি ওএসএটি (আউটসোর্সড সেমিকন্ডাক্টর অ্যাসেম্বলি অ্যান্ড টেস্ট) সুবিধা স্থাপন করছে।
এছাড়া, টোকিও ইলেকট্রন এবং টাটা ইলেকট্রনিক্সের মধ্যে ভারতের সেমিকন্ডাক্টর ইকোসিস্টেমকে শক্তিশালী করার জন্য একটি কৌশলগত সহযোগিতা গড়ে উঠেছে। তামিলনাড়ুর বিনিয়োগ প্রচার কর্মসূচির জন্য জাপান যেন ঋণ সহায়তা প্রদান করেছে, যা সেমিকন্ডাক্টর সহ উদীয়মান প্রযুক্তির স্টার্টআপগুলিকে অর্থায়ন করবে।
কাজুয়া নাকাজোর মতে, এই সহযোগিতা কেবলমাত্র বাণিজ্যিক লক্ষ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং সাপ্লাই চেইনের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, “আমরা শুধুমাত্র পণ্য উৎপাদনের জন্য নয়, বরং উদ্ভাবনী প্রযুক্তি এবং মানবসম্পদ বিনিময়ের মাধ্যমে শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করছি।”
জেট্রো ভারতের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে জাপানের প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং ভারতের দক্ষ মানবসম্পদ ও বিশাল বাজারের সমন্বয় ঘটাতে চায়। এই সহযোগিতায় জাপানের র্যাপিডাসের মতো কোম্পানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, যারা ২ ন্যানোমিটার চিপ উৎপাদনের জন্য গবেষণা ও উন্নয়নে নিয়োজিত।
এই সফরে ভারত ও জাপানের মধ্যে ‘ইন্ডিয়া-জাপান ডায়ালগ অন ইকোনমিক সিকিউরিটি’ নামে একটি নতুন ফ্রেমওয়ার্ক চালু হয়েছে, যা সেমিকন্ডাক্টর, পরিচ্ছন্ন শক্তি, ফার্মাসিউটিক্যালস এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির মতো কৌশলগত খাতে সহযোগিতা বাড়াবে। এছাড়া, এনটিটি ডেটা এবং নেইসা নেটওয়ার্কস হায়দ্রাবাদে একটি বৃহৎ এআই ডেটা সেন্টার ক্লাস্টার স্থাপনের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে।
মহাকাশ খাতে সহযোগিতার জন্য ভারতের ইসরো এবং জাপানের জাক্সার মধ্যে সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা যৌথ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ এবং গবেষণার পথ প্রশস্ত করবে।
জাপানের সেমিকন্ডাক্টর শিল্প, যা একসময় বিশ্ব বাজারের ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করত, বর্তমানে মাত্র ১০ শতাংশ শেয়ার ধরে রেখেছে। তবে, জাপানী কোম্পানিগুলি সিলিকন ওয়েফার, লিথোগ্রাফি সরঞ্জাম এবং রাসায়নিক পদার্থের মতো সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ সরবরাহে এখনও বিশ্বনেতা।
টোকিও ইলেকট্রন, শিন-এৎসু কেমিক্যাল এবং এডভানটেস্টের মতো কোম্পানিগুলি ভারতের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে এই শিল্পকে আরও শক্তিশালী করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ভারতের পক্ষ থেকে, দেশের প্রাণবন্ত ডিজাইন ইকোসিস্টেম এবং শীর্ষ আটটি সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানির ভারতে ডিজাইন সেন্টার থাকার সুবিধা এই সহযোগিতাকে আরও ফলপ্রসূ করছে।
কাজুয়া নাকাজো আরও বলেন, “এই সহযোগিতা কেবল দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করবে না, বরং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।” ভারত ও জাপান উভয়ই মিনারেল সিকিউরিটি পার্টনারশিপ এবং কোয়াড ক্রিটিকাল মিনারেলস ইনিশিয়েটিভের মতো বহুপাক্ষিক ফ্রেমওয়ার্কের মাধ্যমে সমন্বিতভাবে কাজ করছে।
এই সহযোগিতা ভারতের ‘সাগর’ (সিকিউরিটি অ্যান্ড গ্রোথ ফর অল ইন দ্য রিজিয়ন) নীতিকে সমর্থন করছে, যা অঞ্চলের সামুদ্রিক সংযোগ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে উৎসাহিত করে।
১০০ ফুট গভীরে তুষারের ঘন চাদরের নিচে গোপন শহর, নাসার বিজ্ঞানীরা হতবাক
এই সফরে ভারত ও জাপান উভয় দেশই উন্নত প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সহযোগিতার মাধ্যমে বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনকে শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে। কাজুয়া নাকাজোর বক্তব্যে এই সহযোগিতার বৈচিত্র্য এবং এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব স্পষ্ট হয়েছে। ভারতের ক্রমবর্ধমান স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম এবং জাপানের প্রযুক্তিগত দক্ষতার সমন্বয় এই অংশীদারিত্বকে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।