জম্মু ও কাশ্মীরে (Jammu and Kashmir) সাম্প্রতিক সীমান্ত শেলিংয়ে প্রিয়জন হারানো প্রতিটি পরিবারের একজন সদস্যকে সরকারি চাকরি দেওয়ার ঘোষণা করেছেন উপরাজ্যপাল মনোজ সিনহা। বুধবার (২১ মে ২০২৫) পুঞ্চ জেলায় সফরকালে তিনি এই ঘোষণা করেন, জানিয়ে দিয়ে যে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পুনর্বাসন তাঁর প্রশাসনের শীর্ষ অগ্রাধিকার। পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী শেলিংয়ে ২৭ জন নিহত এবং ৭০ জনেরও বেশি আহত হওয়ার পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার ফলাফল। এই প্রতিবেদনে এই ঘোষণার বিস্তারিত এবং এর অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হল।
শেলিংয়ের পট্টভূমি
গত ২২ এপ্রিল পাহালগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নাগরিক নিহত হওয়ার পর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। এর জবাবে ভারত ৭ মে ‘অপারেশন সিন্দুর’ শুরু করে, যার মাধ্যমে পাকিস্তান ও পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরে (পিওকে) সন্ত্রাসী অবকাঠামো লক্ষ্য করে আঘাত হানা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান ৮ থেকে ১০ মে পুঞ্চ, রাজৌরি, বারামুল্লা এবং কুপওয়ারা জেলায় ব্যাপক শেলিং ও ড্রোন হামলা চালায়, যার ফলে ২৭ জন নাগরিক নিহত এবং ৭০ জনেরও বেশি আহত হন। এই হামলায় ২০০টিরও বেশি বাড়ি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সীমান্তবর্তী গ্রাম থেকে হাজার হাজার মানুষ সরকারি ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন।
সরকারি চাকরির ঘোষণা
পুঞ্চ সফরকালে উপরাজ্যপাল মনোজ সিনহা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “আমরা আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। শেলিংয়ে প্রিয়জন হারানো প্রতিটি পরিবারের একজন সদস্যকে সরকারি চাকরি দেওয়া হবে।” এই ঘোষণা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য আর্থিক স্থিতিশীলতা ও দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও জানান, প্রতিটি পরিবারকে ইতিমধ্যে ১৬ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে এবং আহতদের জন্য সরকারি নিয়ম অনুযায়ী সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে।
পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ
মনোজ সিনহা জানান, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের নির্দেশনায় জম্মু ও কাশ্মীর প্রশাসন দ্রুত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের জন্য কাজ করছে। তিনি বলেন, “ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণের জন্য একটি মূল্যায়ন প্রক্রিয়া চলছে। এটি সম্পন্ন হলেই ক্ষতিপূরণ বিতরণ করা হবে।” শেলিংয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং ধর্মীয় স্থানগুলোর পুনর্নির্মাণের জন্য প্রশাসন তৎপর। সিনহা পাকিস্তানের গুরুদ্বারা, মন্দির এবং মসজিদের উপর হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেন, “এটি সামাজিক সম্প্রীতি নষ্ট করার কাপুরুষোচিত প্রচেষ্টা। পুঞ্চের জনগণের সাহস আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীকে অনুপ্রাণিত করেছে।”
নিরাপত্তা অবকাঠামোর উন্নয়ন
শেলিংয়ের ঘটনা সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা অবকাঠামোর ঘাটতি তুলে ধরেছে। উপরাজ্যপাল ঘোষণা করেছেন যে সিকিউরিটি রিলেটেড এক্সপেন্ডিচার (এসআরই) স্কিমের অধীনে ব্যক্তিগত এবং কমিউনিটি বাঙ্কার নির্মাণের কাজ ব্যাপকভাবে শুরু হবে। তিনি বলেন, “বাঙ্কারের সংখ্যা পর্যাপ্ত নয়। সীমান্ত জেলাগুলোতে আরও বাঙ্কার নির্মাণের জন্য আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি।” এছাড়া, তিনি জেলা হাসপাতালে চিকিৎসা সুবিধার উন্নয়ন এবং সিভিল ডিফেন্স সিস্টেম জোরদার করার নির্দেশ দিয়েছেন।
অপারেশন সিন্দুর ও নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা
উপরাজ্যপাল সিনহা ‘অপারেশন সিন্দুর’-এর সাফল্যের জন্য ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, “মাত্র ২৩ মিনিটে আমাদের সৈন্যরা পাকিস্তানের সন্ত্রাসী মদতদাতাদের হাঁটু গেড়ে বসিয়েছে। পাকিস্তান এখন জানে যে ভবিষ্যতে কোনো দুঃসাহসিকতার জন্য তাদের ভারী মূল্য দিতে হবে।” তিনি জনগণের প্রতি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব
সরকারি চাকরির ঘোষণা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য আর্থিক স্থিতিশীলতা নিয়ে আসবে। এটি তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে এবং দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক সুরক্ষা প্রদান করবে। তবে, এই সিদ্ধান্তের অর্থনৈতিক প্রভাবও রয়েছে। সরকারি চাকরির সংখ্যা বৃদ্ধি সরকারের ব্যয় বাড়াবে, যা রাজস্ব ঘাটতি সৃষ্টি করতে পারে। তবে, এই পদক্ষেপ স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে, কারণ কর্মচারীদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রম বৃদ্ধি পাবে।
এছাড়া, বাঙ্কার নির্মাণ ও চিকিৎসা সুবিধার উন্নয়ন স্থানীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং সীমান্ত এলাকার জনগণের নিরাপত্তা বাড়াবে। এই উদ্যোগগুলো সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোর জনগণের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনবে এবং তাদের জীবনযাত্রাকে স্বাভাবিক করতে সহায়তা করবে।
স্থানীয় জনগণের প্রতিক্রিয়া
পুঞ্চের স্থানীয় বাসিন্দারা উপরাজ্যপালের এই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন। একজন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্য বলেন, “এই চাকরি আমাদের পরিবারের জন্য নতুন আশা নিয়ে এসেছে। ক্ষতিপূরণ এবং চাকরি আমাদের জীবন পুনর্গঠনে সহায়তা করবে।” তবে, কিছু পরিবার আরও বেশি ক্ষতিপূরণ এবং দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসনের দাবি জানিয়েছে।
উপরাজ্যপাল মনোজ সিনহার ঘোষণা সীমান্ত শেলিংয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। সরকারি চাকরি, ক্ষতিপূরণ এবং নিরাপত্তা অবকাঠামোর উন্নয়ন তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে এবং সীমান্ত এলাকায় স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনবে। তবে, এই উদ্যোগগুলোর সফল বাস্তবায়নের জন্য দ্রুত ও স্বচ্ছ প্রশাসনিক পদক্ষেপ প্রয়োজন। জম্মু ও কাশ্মীর প্রশাসনের এই প্রচেষ্টা ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করে এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের বার্তা দেয়।