ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ISRO-এর PSLV-C60 রকেটটি ২০২৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর রাত ১০টা ০০ মিনিট ১৫ সেকেন্ড IST-তে শ্রীহরিকোটার প্রথম লঞ্চ প্যাড থেকে মহাকাশে যাত্রা শুরু করছে। এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মিশন, কারণ এর মাধ্যমে ISRO একটি অত্যাধুনিক মহাকাশ ডকিং প্রযুক্তি প্রদর্শন করতে চলেছে, যা ভবিষ্যতে বিভিন্ন মহাকাশ অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এই মিশনটি হলো SpaDex (Space Docking Experiment), যা মহাকাশে দুটি স্যাটেলাইটের মধ্যে রেনডেভুজ এবং ডকিং পরীক্ষা করবে।
PSLV-C60 রকেটটি ISRO-এর অত্যন্ত সফল এবং বিশ্বস্ত রকেট, যা বেশিরভাগ মহাকাশ মিশনে ব্যবহৃত হয়। এটি ‘কোর অ্যালোন’ (CA) কনফিগারেশনে উড়ান করছে, অর্থাৎ কোনো অতিরিক্ত স্ট্র্যাপ-অন বুস্টার ছাড়াই। এই রকেটটি মহাকাশে পাঠাবে দুটি স্যাটেলাইট, যার মোট ওজন প্রায় ৪৪০ কিলোগ্রাম (প্রতিটি ২২০ কেজি)। এই স্যাটেলাইট দুটি হল চেজার এবং টার্গেট, এবং উভয়টি একে অপরের ভূমিকা পালন করতে সক্ষম, যদি কোনো কারণে একটির কার্যকারিতা ব্যাহত হয়।
এই মিশনের লক্ষ্য হলো, মহাকাশে একটি স্যাটেলাইট অন্য স্যাটেলাইটের কাছে পৌঁছে গিয়ে তা সংযুক্ত বা ডকিং করতে সক্ষম হবে কিনা তা পরীক্ষা করা। এই ধরনের প্রযুক্তি ভবিষ্যতে ISRO-এর বিভিন্ন মহাকাশ মিশনে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে, বিশেষ করে চন্দ্রযান-৪ মিশনে চাঁদের মাটি থেকে নমুনা সংগ্রহের সময় এবং ভারতীয় আন্তরিক্ষ স্টেশন তৈরির জন্য।
রকেট ও স্যাটেলাইটগুলির যাত্রা
PSLV-C60 রকেটটি সঠিকভাবে দুটি স্যাটেলাইটকে মহাকাশে স্থাপন করেছে, যা ৪৭৫ কিলোমিটার উচ্চতায় একটি সঞ্চালনমূলক কক্ষপথে (circular orbit) অবস্থান করবে। এই স্যাটেলাইট দুটি খুব কাছাকাছি, প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরত্বে চলে আসবে। এরপর চেজার স্যাটেলাইটটি ধীরে ধীরে টার্গেট স্যাটেলাইটটির কাছে পৌঁছে গিয়ে সংযুক্ত হবে। এই প্রক্রিয়া খুবই নিখুঁত হওয়া প্রয়োজন, যাতে কোনো ভুল না হয়।
এই পরীক্ষার মাধ্যমে ISRO মহাকাশে ডকিং প্রযুক্তির সক্ষমতা যাচাই করবে, এবং সফল হলে এটি হবে পৃথিবীর চতুর্থ দেশ হিসেবে মহাকাশে ডকিং প্রযুক্তি প্রদর্শনকারী দেশ। এর আগে, আমেরিকা, রাশিয়া, এবং চীন এই প্রযুক্তি সফলভাবে প্রদর্শন করেছে।
ডকিং প্রযুক্তি এবং তার গুরুত্ব
মহাকাশে ডকিং হল দুটি মহাকাশযানের একে অপরের সঙ্গে সুরক্ষিতভাবে সংযুক্ত হওয়া, যাতে তারা একে অপরের সঙ্গে তথ্য বা শক্তি বিনিময় করতে পারে। এই প্রযুক্তি ভবিষ্যতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যখন মহাকাশে বড় প্রকল্প, যেমন আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (ISS) বা ভারতীয় আন্তরিক্ষ স্টেশন তৈরি করতে হবে।
SpaDex মিশনে ডকিং প্রযুক্তির পরীক্ষার জন্য দুটি স্যাটেলাইটে বিশেষভাবে উন্নত লেজার রেঞ্জফাইন্ডার, রেনডেভুজ সেন্সর, এবং প্রক্সিমিটি ও ডকিং সেন্সর যুক্ত করা হয়েছে, যা স্যাটেলাইটগুলির মধ্যে সঠিক যোগাযোগ এবং সঠিকভাবে ডকিং করার সুবিধা প্রদান করবে। এছাড়া, স্যাটেলাইটগুলিতে শক্তি উৎপাদন করার জন্য সোলার প্যানেল যুক্ত করা হয়েছে, এবং এক স্যাটেলাইট অন্য স্যাটেলাইটে শক্তি স্থানান্তর করতে সক্ষম হবে, যা এই প্রযুক্তির আরেকটি লক্ষ্য।
ডকিং প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে, দুটি স্যাটেলাইটই তাদের প্ল্যাটফর্ম থেকে অতিরিক্ত ২৪টি প্লেয়ড চালাবে, যেগুলি ভারতীয় শিল্প ও অ্যাকাডেমির অংশীদারিত্বে তৈরি। এই প্ল্যাটফর্মটি, যার নাম POEM (PSLV Orbital Experiment Module), এর মাধ্যমে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নতুন উদ্ভাবনের প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।
ISRO-এর ঐতিহাসিক মাইলফলক
এটি ছিল ISRO-এর ৯৯তম কক্ষপথে উৎক্ষেপণ, এবং আগামী মিশন, GSLV-F15/NVS02 উৎক্ষেপণটি হবে ১০০তম উৎক্ষেপণ। এটি ISRO-এর জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, এবং আশা করা হচ্ছে যে পরবর্তী উৎক্ষেপণটি আরও একটি বড় সাফল্যের দিকে এগিয়ে নেবে।
ISRO চেয়ারম্যান এস সোমনাথ মিশনের সফল উৎক্ষেপণ সম্পর্কে বলেন, “আমি খুবই আনন্দিত যে PSLV-C60 সফলভাবে SpaDex স্যাটেলাইটগুলোকে সঠিক কক্ষপথে স্থাপন করতে পেরেছে। এখন আমরা আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছি, যেখানে রকেটটির চতুর্থ স্তর তার কক্ষপথ ৪৭৫ কিলোমিটার থেকে ৩৫০ কিলোমিটার কম করবে, যাতে POEM অপারেশন সম্ভব হয়। আশা করছি ডকিং প্রক্রিয়া ৭ জানুয়ারির মধ্যে সম্পন্ন হবে।”
ভবিষ্যতের মহাকাশ অভিযান
ISRO-এর এই মিশন শুধুমাত্র একটি প্রযুক্তিগত পরীক্ষা নয়, এটি ভারতের মহাকাশ অভিযানে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এই পরীক্ষার সফলতার মাধ্যমে, ISRO ভবিষ্যতে আরও বড় এবং জটিল মহাকাশ মিশনগুলো পরিচালনার সক্ষমতা অর্জন করবে, যেমন চাঁদের মাটি থেকে নমুনা সংগ্রহ করা, নতুন মহাকাশ স্টেশন তৈরি করা এবং বৃহৎ স্যাটেলাইট মিশন পরিচালনা করা।
মহাকাশে সফলভাবে ডকিং করতে পারলে, এটি আন্তর্জাতিক মহাকাশ সম্প্রদায়ে ভারতের অবস্থান আরও শক্তিশালী করবে এবং বিশ্বব্যাপী মহাকাশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ভারতকে একটি নেতৃস্থানীয় ভূমিকা দিতে সহায়ক হবে।
ISRO-এর PSLV-C60 রকেটের সফল উৎক্ষেপণ এবং SpaDex মিশনের মাধ্যমে মহাকাশ ডকিং প্রযুক্তি পরীক্ষার এই যাত্রা পৃথিবীকে নতুন এক দিগন্তে পৌঁছে দিতে সাহায্য করবে। এটি শুধু ভারত নয়, বরং পুরো পৃথিবীর মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে চলেছে।