মহেন্দ্রগিরিতে ইসরোর সেমিক্রায়োজেনিক ইঞ্জিনের সফল হট টেস্ট

ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো) তার সেমিক্রায়োজেনিক ইঞ্জিনের (Semicryogenic Engine) উন্নয়ন কর্মসূচিতে আরেকটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। তামিলনাড়ুর মহেন্দ্রগিরিতে অবস্থিত ইসরো প্রপালশন কমপ্লেক্সে (আইপিআরসি) ২৪…

ISRO Successfully Conducts Short Duration Hot Test of Semi Cryogenic Engine at Mahendragiri

ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো) তার সেমিক্রায়োজেনিক ইঞ্জিনের (Semicryogenic Engine) উন্নয়ন কর্মসূচিতে আরেকটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। তামিলনাড়ুর মহেন্দ্রগিরিতে অবস্থিত ইসরো প্রপালশন কমপ্লেক্সে (আইপিআরসি) ২৪ এপ্রিল একটি স্বল্প সময়ের হট টেস্ট সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ইসরোর মতে, এই ইগনিশন পরীক্ষাটি সেমিক্রায়োজেনিক ইঞ্জিন পরীক্ষা কর্মসূচির দ্বিতীয় মাইলফলক, যা ২৮ মার্চ ২০২৫-এ প্রথম সফল হট টেস্টের পর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

   

ইসরোর একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই পরীক্ষায় ইঞ্জিন পাওয়ার হেড টেস্ট আর্টিকল (পিএইচটিএ), যা থ্রাস্ট চেম্বার ব্যতীত ইঞ্জিনের সমস্ত সিস্টেমকে অন্তর্ভুক্ত করে, ৩.৫ সেকেন্ডের জন্য হট টেস্টের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হয়েছে। এই পরীক্ষা ইঞ্জিনের স্টার্ট-আপ সিকোয়েন্সের বৈধতা যাচাই করেছে। পরীক্ষার সময় ইঞ্জিনটি সফলভাবে ইগনিশন করা হয় এবং এটি তার নির্ধারিত শক্তির ৬০ শতাংশ পর্যন্ত স্থিতিশীল ও নিয়ন্ত্রিত পারফরম্যান্স প্রদর্শন করেছে।

ইসরো জানিয়েছে, এই পরীক্ষাগুলি গুরুত্বপূর্ণ সাবসিস্টেম যেমন নিম্ন-চাপ এবং উচ্চ-চাপ টার্বো পাম্প, প্রি-বার্নার এবং সম্পর্কিত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার নকশা অখণ্ডতা এবং পারফরম্যান্স যাচাই করার জন্য পরিকল্পিত একটি সিরিজের অংশ। এই পরীক্ষার ফলাফল সম্পূর্ণ সেমিক্রায়োজেনিক ইঞ্জিনের অপারেশনাল সিকোয়েন্সিং চূড়ান্ত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করেছে। ইসরো আরও জানায়, ইঞ্জিন সিস্টেমের ব্যাপক বৈধতার জন্য আরও যোগ্যতা পরীক্ষার পরিকল্পনা করা হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত ইসরোর লঞ্চ ভেহিকলগুলিতে এই ইঞ্জিনের অন্তর্ভুক্তির পথ প্রশস্ত করবে।

Semicryogenic Engine: ভারতের মহাকাশ গবেষণায় নতুন দিগন্ত

সেমিক্রায়োজেনিক ইঞ্জিনটি ২০০০ কিলোনিউটন (kN) থ্রাস্ট সহ একটি উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন ইঞ্জিন, যা লিকুইড অক্সিজেন (LOX) এবং কেরোসিন প্রোপেলান্টের সমন্বয়ে কাজ করে। এই ইঞ্জিনটি ইসরোর লঞ্চ ভেহিকল মার্ক-৩ (LVM3)-এর সেমিক্রায়োজেনিক বুস্টার স্টেজ (SC120) কে শক্তি প্রদান করবে। বর্তমানে LVM3-এর কোর লিকুইড স্টেজ (L110) এর পরিবর্তে এই SC120 স্টেজ ব্যবহার করা হবে, যা পেলোড ক্ষমতা ৪ টন থেকে ৫ টনে উন্নীত করবে জিওসিনক্রোনাস ট্রান্সফার অরবিটে (GTO)। এই উন্নতি ভারতের মহাকাশ মিশনগুলিকে আরও ভারী স্যাটেলাইট এবং গভীর মহাকাশ অভিযানের জন্য সক্ষম করবে।

ইসরোর লিকুইড প্রপালশন সিস্টেমস সেন্টার (LPSC) এই SE2000 ইঞ্জিনের নকশা ও উন্নয়নের দায়িত্বে রয়েছে, যেখানে ভারতীয় শিল্পের সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই ইঞ্জিনটি অক্সিডাইজার-রিচ স্টেজড কম্বাশন সাইকেলে কাজ করে, যা ১৮০ বারের উচ্চ চেম্বার প্রেসার এবং ৩৩৫ সেকেন্ডের স্পেসিফিক ইমপালস প্রদান করে। এই প্রযুক্তি বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন এবং জাপানের মতো কয়েকটি দেশের কাছেই রয়েছে, এবং এই সাফল্য ভারতকে উচ্চ-থ্রাস্ট সেমিক্রায়োজেনিক প্রপালশন প্রযুক্তিতে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশগুলির মধ্যে নিয়ে এসেছে।

পরীক্ষার গুরুত্ব ও প্রযুক্তিগত বিবরণ

এই হট টেস্টটি পিএইচটিএ-এর মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে, যা ইঞ্জিনের সমস্ত সিস্টেমকে অন্তর্ভুক্ত করে, থ্রাস্ট চেম্বার ব্যতীত। পরীক্ষার উদ্দেশ্য ছিল প্রি-বার্নার, টার্বো পাম্প, স্টার্ট সিস্টেম এবং নিয়ন্ত্রণ উপাদানগুলির সমন্বিত পারফরম্যান্স যাচাই করা। ৩.৫ সেকেন্ডের এই পরীক্ষায় ইঞ্জিনটি সফলভাবে ইগনিশন করা হয় এবং এটি স্থিতিশীলভাবে কাজ করেছে, যা ইঞ্জিনের স্টার্ট-আপ প্রক্রিয়ার নির্ভরযোগ্যতা প্রমাণ করেছে।

ইসরোর মতে, এই পরীক্ষাগুলি ইঞ্জিনের নকশা এবং পারফরম্যান্সকে আরও উন্নত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পূর্ববর্তী পরীক্ষায় (মার্চ ২০২৫) ২.৫ সেকেন্ডের হট টেস্টে ইঞ্জিনের মসৃণ ইগনিশন এবং বুস্ট স্ট্র্যাপ মোড অপারেশন প্রদর্শিত হয়েছিল। এই ধারাবাহিক সাফল্যগুলি ইঞ্জিনের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় একটি শক্ত ভিত্তি প্রদান করছে।

অত্যাধুনিক পরীক্ষার সুবিধা

এই পরীক্ষাগুলি মহেন্দ্রগিরির সেমিক্রায়োজেনিক ইন্টিগ্রেটেড ইঞ্জিন টেস্ট ফ্যাসিলিটি (SIET)-তে পরিচালিত হয়েছে, যা ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উৎসর্গ করেছিলেন। এই অত্যাধুনিক সুবিধাটি ২৬০০ কিলোনিউটন পর্যন্ত থ্রাস্ট সহ ইঞ্জিন পরীক্ষার জন্য সক্ষম এবং এটি উন্নত পিএলসি-ভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং ডেটা অধিগ্রহণ সিস্টেমে সজ্জিত। এই সুবিধাটি ইসরোর ভবিষ্যৎ মহাকাশ মিশনগুলির জন্য ইঞ্জিন এবং স্টেজ পরীক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

ভারতীয় শিল্পের অংশগ্রহণ

ইসরোর এই প্রকল্পে ভারতীয় শিল্পের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ রয়েছে। ইঞ্জিনের জন্য স্পেস-গ্রেড কেরোসিন এবং বিশেষ উপকরণ, যা উচ্চ তাপমাত্রা এবং অক্সিডাইজার-রিচ কম্বাশন সহ্য করতে পারে, ভারতীয় শিল্পের সহযোগিতায় তৈরি করা হয়েছে। এই সহযোগিতা ভারতের উচ্চ-প্রযুক্তি শিল্পের ক্ষমতাকে শক্তিশালী করছে এবং দেশীয় উৎপাদনের উপর জোর দিচ্ছে।

ভবিষ্যতের সম্ভাবনা

সেমিক্রায়োজেনিক ইঞ্জিনটি ভারতের মহাকাশ মিশনগুলির জন্য একটি গেম-চেঞ্জার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এটি LVM3-এর পেলোড ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি ভবিষ্যতের লঞ্চ ভেহিকলগুলির বুস্টার স্টেজে শক্তি প্রদান করবে। এই ইঞ্জিনটি গগনযান মানব মহাকাশ মিশন এবং চাঁদ ও মঙ্গল গ্রহে বড় প্রোব পাঠানোর মতো উচ্চাভিলাষী প্রকল্পগুলির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে। এছাড়া, এই ইঞ্জিনটি অ-বিষাক্ত এবং পরিবেশ-বান্ধব প্রোপেলান্ট ব্যবহার করে, যা এটিকে আরও টেকসই করে তোলে।

ইসরোর চেয়ারম্যান এস. সোমনাথ এই অর্জনকে প্রপালশন প্রযুক্তিতে একটি “কোয়ান্টাম লিপ” হিসেবে অভিহিত করেছেন। এই সাফল্য ভারতকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থাগুলির সমকক্ষ করে তুলেছে।

ইসরোর সেমিক্রায়োজেনিক ইঞ্জিনের সফল হট টেস্ট ভারতের মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এই প্রযুক্তি ভারতের লঞ্চ ভেহিকলগুলির ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষণায় ভারতের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে। ইসরোর এই ধারাবাহিক সাফল্য দেশের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ এবং উদ্ভাবনের প্রতি প্রতিশ্রুতিকে প্রতিফলিত করে।