২২ এপ্রিল ২০২৫, জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ের বাইসারান মেডোতে ঘটে যাওয়া জঙ্গি হামলায় ২৬ জন পর্যটক নিহত এবং ২০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন। এই হামলার দায় স্বীকার করেছে দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ), যা পাকিস্তান-ভিত্তিক লস্কর-ই-তৈবার একটি শাখা।
এই ঘটনা ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় গুরুতর ত্রুটি এবং গোয়েন্দা ব্যর্থতার প্রশ্ন তুলেছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা জার্নাল ও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন জঙ্গিবাদের মূল কারণ, ফান্ডিংয়ের (funding) পদ্ধতি এবং পহেলগাঁও হামলার আগে গোয়েন্দা ব্যর্থতার কারণগুলি বিশ্লেষণ করা হল।
সন্ত্রাসবাদের মূল কারণ
জঙ্গিবাদের মূল কারণ জটিল এবং বহুমুখী। গোয়েন্দা জার্নালগুলি রাজনৈতিক অস্থিরতা, ধর্মীয় উগ্রবাদ, সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনাকে প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে। পাহলগাম হামলার ক্ষেত্রে, টিআরএফ দাবি করেছে যে, কাশ্মীর উপত্যকায় ‘জনসংখ্যাগত পরিবর্তন’ রোধ করাই তাদের লক্ষ্য।
২০১৯ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল এবং ৮৫,০০০ ডোমিসাইল সার্টিফিকেট ইস্যুকে তারা ‘অবৈধ বসতি’ হিসেবে দেখছে। গোয়েন্দা বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তানের ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) এবং খোদ সেনা বাহিনী এই ধরনের গোষ্ঠীগুলিকে উস্কানি দেয়, কাশ্মীরকে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ব্যবহার করে। এছাড়া, সামাজিক মাধ্যমে ধর্মীয় বিভাজন ও উগ্রবাদী প্রচারণা তরুণদের মধ্যে উগ্রবাদের প্রতি আকর্ষণ বাড়ায়।
নাশকতার জন্য ফান্ডিং পদ্ধতি (funding)
জঙ্গিবাদের ফান্ডিং (funding) বিশ্বব্যাপী একটি জটিল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফএটিএফ)-এর প্রতিবেদন অনুসারে, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলি মাদক পাচার, অর্থ পাচার, হাওয়ালা লেনদেন, এবং ক্রাউডফান্ডিংয়ের মতো পদ্ধতি ব্যবহার করে।
পহেলগাঁও হামলার ক্ষেত্রে, সামাজিক মাধ্যমে কিছু পোস্টে দাবি করা হয়েছে যে, গুজরাটের বন্দর দিয়ে মাদক পাচারের অর্থ লস্কর-ই-তৈবার (funding) হাতে পৌঁছেছে, যা এই হামলার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। যদিও এই দাবি স্বাধীনভাবে যাচাই করা যায়নি, গোয়েন্দা জার্নালগুলি নির্দেশ করে যে, পাকিস্তান-ভিত্তিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলি আইএসআই-এর সমর্থনে মাদক ব্যবসা এবং সীমান্ত পারে অস্ত্র ও মাদক পাচার থেকে তহবিল সংগ্রহ করে।
এছাড়া, সামাজিক মাধ্যমে ক্রাউডফান্ডিং (funding) প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী সমর্থকদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করা হয়। ২০২৩ সালে পাকিস্তানের ন্যাশনাল রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্টে সন্ত্রাসী ফান্ডিংয়ের এই পদ্ধতিগুলি উল্লেখ করা হয়েছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক জঙ্গি সংগঠন, যা অনেক শক্তিশালী দেশের উপর গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে
গোয়েন্দা ব্যর্থতার কারণ
পহেলগাঁও হামলা গোয়েন্দা ব্যর্থতার একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়গে এবং এআইএমআইএম নেতা আসাদুদ্দিন ওয়াইসি এই ঘটনাকে ‘গোয়েন্দা ব্যর্থতা’ হিসেবে সমালোচনা করেছেন। গোয়েন্দা জার্নালগুলি বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছে যেমন, প্রাথমিক তথ্যের অভাব রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং (র) এবং ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি) পহেলগাঁওয়ে সন্দেহজনক গতিবিধি সম্পর্কে কিছু তথ্য পেয়েছিল, কিন্তু হামলার সময় এবং স্থান সম্পর্কে নির্দিষ্ট তথ্য জোগাড় করতে পারেনি।
তথ্য থেকে পদক্ষেপে ব্যর্থতা গোয়েন্দা সংস্থাগুলি জানত যে, সন্ত্রাসীরা এলাকায় রেকি করছে, কিন্তু তৎক্ষণাৎ নিরাপত্তা বাড়ানোর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতি বাইসারান মেডোতে পর্যটকদের যাওয়ার জন্য পুলিশের অনুমতি ছিল না, এবং এলাকাটি শুধুমাত্র পায়ে বা ঘোড়ায় যাওয়া যায়, যা নিরাপত্তা বাহিনীর দ্রুত প্রতিক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
পাকিস্তানের ভূমিকা পাকিস্তানের আইএসআই-এর সমর্থনে টিআরএফ এই হামলার পরিকল্পনা করে। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরের কাশ্মীরকে ‘পাকিস্তানের জীবনরেখা’ বলা হামলার পূর্বে উস্কানিমূলক প্রভাব ফেলেছে। গোয়েন্দা বিশ্লেষক অজয় সাহনি জানিয়েছেন, টিআরএফ-এর সমস্ত অপারেশন মূলত লস্কর-ই-তৈবার নির্দেশে পরিচালিত হয়, যা পাকিস্তানের সমর্থন ছাড়া সম্ভব নয়। এই হামলার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে লস্কর কমান্ডার সাইফুল্লাহ কাসুরি (উপনাম খালিদ)-কে চিহ্নিত করা হয়েছে।
সরকারের প্রতিক্রিয়া এবং ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ
হামলার পর ভারত সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করেছে এবং পাকিস্তান শিমলা চুক্তি স্থগিত করেছে, যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নতুন সংকট তৈরি করেছে। জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ তিনজন সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীর স্কেচ প্রকাশ করেছে এবং তাদের গ্রেফতারের জন্য ২০ লক্ষ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করেছে। ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ) তদন্ত শুরু করেছে। গোয়েন্দা জার্নালগুলি পরামর্শ দেয় যে, ভারতকে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করতে হবে এবং সীমান্তে নজরদারি বাড়াতে হবে।
পহেলগাঁও হামলা সন্ত্রাসবাদের জটিল কারণ, দেশের ভিতরেই ফান্ডিংয়ের গোপন নেটওয়ার্ক এবং গোয়েন্দা ব্যর্থতার একটি স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরেছে। পাকিস্তানের সমর্থনে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলি কাশ্মীরে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে, যখন গোয়েন্দা সংস্থাগুলি নির্দিষ্ট তথ্যের অভাব এবং সমন্বয়ের ঘাটতিতে ভুগছে। এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভারতকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এমন ট্র্যাজেডি এড়ানো যায়।