পাকিস্তানকে নজরে রাখতে আরব সাগরে মোতায়েন ’৭১ যুদ্ধের হিরো বিক্রান্ত

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে ভারতীয় নৌবাহিনী তার প্রথম স্বদেশী বিমানবাহী রণতরী আইএনএস বিক্রান্তকে (INS Vikrant ) আরব সাগরের করওয়ার উপকূলের কাছে মোতায়েন…

INS Vikrant Deployed Amid India-Pakistan Tensions, Signals Strong Naval Posture

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে ভারতীয় নৌবাহিনী তার প্রথম স্বদেশী বিমানবাহী রণতরী আইএনএস বিক্রান্তকে (INS Vikrant ) আরব সাগরের করওয়ার উপকূলের কাছে মোতায়েন করেছে। এই মোতায়েনের পেছনে রয়েছে পহেলগাঁওে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলা, যাতে ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন এবং সীমান্ত-পার সন্ত্রাসবাদ ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের প্রাপ্ত স্যাটেলাইট চিত্র নিশ্চিত করেছে যে আইএনএস বিক্রান্ত তার বন্দর ছেড়ে বর্তমানে কর্ণাটকের করওয়ার উপকূলের কাছে টহল দিচ্ছে।

   

২৫ এপ্রিল, ২০২৫-এর স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, আইএনএস বিক্রান্তের সাথে রয়েছে একটি শক্তিশালী স্ট্রাইক গ্রুপ, যার মধ্যে রয়েছে একটি ডেস্ট্রয়ার, ফ্রিগেট, সাবমেরিন-বিরোধী যুদ্ধজাহাজ এবং অন্যান্য সহায়ক জাহাজ। ভারতের পশ্চিম উপকূলে এই সমন্বিত গ্রুপের অবস্থান নৌ কৌশলে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। পাকিস্তানের সাথে চলমান উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে নয়াদিল্লি এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের জন্য নৌ উপস্থিতি বাড়াচ্ছে। এই মোতায়েনের সময় পাকিস্তান আরব সাগরে একটি ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে, যা আরও উত্তেজনার আশঙ্কা তৈরি করেছে।

আইএনএস বিক্রান্তের মোতায়েন কেন গুরুত্বপূর্ণ?

আইএনএস বিক্রান্ত কেবল একটি বিমানবাহী রণতরী নয়, এটি ভারতের ক্রমবর্ধমান নৌ শক্তি এবং প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে স্বনির্ভরতার প্রতীক। ৪৫,০০০ টন স্থানচ্যুতি, ২৬২ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ৫৯ মিটার প্রস্থ সহ এই রণতরী একটি শক্তিশালী সম্পদ। জেনারেল ইলেকট্রিক টারবাইন দ্বারা চালিত এটি ১.১০ লক্ষ হর্সপাওয়ার উৎপন্ন করে এবং ৪০টি পর্যন্ত উড়োজাহাজ বহন করতে সক্ষম, যার মধ্যে রয়েছে মিগ-২৯কে ফাইটার জেট এবং কা-৩১ হেলিকপ্টার। এছাড়া, এটি ৬৪টি বারাক ক্ষেপণাস্ত্র এবং মারাত্মক ব্রহ্মোস ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থায় সজ্জিত।

এই রণতরী ভারতের ‘আত্মনির্ভর ভারত’ উদ্যোগের প্রতিফলন। ৭৬% স্বদেশী উপাদান দিয়ে নির্মিত এটি কোচিন শিপইয়ার্ড লিমিটেড (সিএসএল) দ্বারা নির্মিত। এর এসটিওবিএআর (শর্ট টেক-অফ বাট অ্যারেস্টেড রিকভারি) সিস্টেম, স্কি-জাম্প এবং অ্যারেস্টার ওয়্যার সহ, এটিকে শক্তিশালী এয়ারক্রাফ্ট ক্যারিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা: প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞের মতামত

পহেলগাঁও সন্ত্রাসী হামলার পর ভারতের সামরিক অবস্থান নিয়ে গুডরিটার্নস-এর সাথে কথা বলতে গিয়ে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ লেফটেন্যান্ট কর্নেল জে এস সোধি (অব.) ভারত সরকারের সিদ্ধান্তের সমর্থন করেছেন। তবে, তিনি তাৎক্ষণিক আক্রমণের প্রত্যাশার বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন, “পহেলগাঁও হামলার পর ভারত কঠোর সামরিক অবস্থান গ্রহণ করে সঠিক কাজ করেছে। তবে, এটি অবিলম্বে পাকিস্তানের কোনো সামরিক স্থাপনায় সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের দ দিকে পরিচালিত হওয়ার সম্ভাবনা কম, কারণ এটি একটি পূর্ণ-মাত্রার যুদ্ধে রূপ নিতে পারে।”

তিনি বর্তমান অপারেশনাল সীমাবদ্ধতার উপর আলোকপাত করে বলেন, “এই মুহূর্তে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ১ লক্ষের বেশি সৈন্যের ঘাটতি রয়েছে, এবং ভারতীয় বিমান বাহিনীর কাছে ৪২টি ফাইটার এয়ারক্রাফ্ট স্কোয়াড্রনের অনুমোদন থাকলেও মাত্র ২৯.৫টি স্কোয়াড্রন রয়েছে।” তিনি আরও উল্লেখ করেন যে চীন পাকিস্তানের সাথে যোগ দিতে পারে, যা দুই ফ্রন্টে যুদ্ধের সম্ভাবনা তৈরি করবে। তিনি বলেন, “ভারত অবশ্যই সামরিকভাবে আঘাত করবে, তবে অবিলম্বে নয়—অন্তত যতক্ষণ না সশস্ত্র বাহিনীর জনবল এবং সরঞ্জামের ঘাটতি পূরণ করা হয়।”

পাকিস্তানের জন্য আইএনএস বিক্রান্ত কতটা হুমকি?

পাকিস্তানের সাথে কোনো সংঘর্ষের ক্ষেত্রে আইএনএস বিক্রান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর আঘাতের পরিসীমা ১,৫০০ কিলোমিটার, যার মানে এটি পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ স্থান যেমন করাচি এবং গোয়াদার বন্দরে সহজেই পৌঁছাতে পারে। এই বন্দরগুলি পাকিস্তানের প্রধান বাণিজ্য পথ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আরব সাগরে বিক্রান্তের উপস্থিতি পাকিস্তানের নৌবাহিনীকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করতে পারে এবং এর বাণিজ্য ও সামরিক সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে। যুদ্ধ শুরু হলে, আইএনএস বিক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এটি আধুনিক অস্ত্র এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সজ্জিত। এর ক্যারিয়ার গ্রুপ

বিমান হামলা থেকে শুরু করে পৃষ্ঠ ও জলের নিচের মিশন পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের অপারেশন পরিচালনা করতে পারে। বিক্রান্তের মিগ-২৯কে ফাইটার জেটগুলি পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ বিমান ঘাঁটি যেমন মাসরুর (করাচি) এবং সারগোধায় আঘাত করতে পারে। এর ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা শত্রুপক্ষের জাহাজ, সাবমেরিন এবং অন্যান্য নৌ লক্ষ্য ধ্বংস করতে সক্ষম।

প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিক্রান্ত পাকিস্তানের প্রধান বন্দর করাচি এবং গোয়াদার বন্ধ করে দিতে পারে, যা সমুদ্রপথে পাকিস্তানের ৬০% বাণিজ্য বন্ধ করতে পারে। এছাড়া, এর ফাইটার জেটগুলি, যা একবারে ৮৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত উড়তে পারে, পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থানে আঘাত করতে পারে, যা পাকিস্তানের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করবে।

একজন প্রাক্তন নৌ কর্মকর্তার মতে, “আইএনএস বিক্রান্ত এই অঞ্চলে গেম-চেঞ্জার। পাকিস্তানের নৌবাহিনী বিক্রান্তের দূরপাল্লার আঘাত, নির্ভুল ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা এবং উড়োজাহাজ মোতায়েনের ক্ষমতার তুলনায় অনেক পিছিয়ে। পাকিস্তানের উপকূলে বিক্রান্তের উপস্থিতি কৌশলগত ভারসাম্যকে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন করবে।” তিনি আরও বলেন, “আইএনএস বিক্রান্ত পাকিস্তানের সমুদ্র বাণিজ্য এবং সামরিক অবকাঠামোতে নির্ভুল আঘাত হানতে পারে, যা পাকিস্তানের অর্থনীতি এবং সামরিক সরবরাহে গুরুতর ক্ষতি করবে।”

১৯৭১ সালের যুদ্ধে আইএনএস বিক্রান্তের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার

আইএনএস বিক্রান্তের মোতায়েনের পেছনে রয়েছে উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার। এটি তার পূর্বসূরির নামে নামকরণ করা হয়েছে, যিনি ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। প্রথম আইএনএস বিক্রান্ত পাকিস্তানের নৌবাহিনী ধ্বংস করতে এবং পূর্ব পাকিস্তানে সরবরাহ বন্ধ করতে সহায়তা করেছিল। নতুন আইএনএস বিক্রান্ত ভারতের ক্রমবর্ধমান নৌ শক্তির প্রমাণ।

পহেলগাঁও হামলার পর ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে, এবং আইএনএস বিক্রান্তের মোতায়েন ভারতের কৌশলগত প্রস্তুতি এবং নৌ শক্তির প্রদর্শন। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিক্রান্ত পাকিস্তানের অর্থনীতি ও সামরিক সক্ষমতার উপর গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে। তবে, তাৎক্ষণিক সামরিক পদক্ষেপের পরিবর্তে ভারত সম্ভবত দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতির দিকে মনোযোগ দেবে। এই পরিস্থিতিতে আইএনএস বিক্রান্ত ভারতের নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক প্রভাব বজায় রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।