ভারতীয় নৌবাহিনীর ইতিহাসে আরেক সোনালি অধ্যায় যোগ হচ্ছে আজ বুধবার। কোচির নৌসেনা ঘাঁটিতে ৬ নভেম্বর ২০২৫-এ আইএনএস ইক্ষাক নামক (INS Ikshak) সার্ভে ভ্যাসেল (লার্জ) শ্রেণির তৃতীয় জাহাজটি আনুষ্ঠানিকভাবে কমিশন করা হবে। এই অনুষ্ঠানে নৌপ্রধান অ্যাডমিরাল দীনেশ কে ত্রিপাঠী উপস্থিত থেকে জাহাজটিকে সার্ভিসে যোগ করবেন। গার্ডেন রিচ শিপবিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স (জিআরএসই) লিমিটেড, কলকাতায় নির্মিত এই জাহাজটি ভারতের আত্মনির্ভর ভারত উদ্যোগের এক জ্বলজ্বল করা উদাহরণ। জাহাজের ৮০ শতাংশেরও বেশি উপাদান দেশীয়, যা জিআরএসই এবং ভারতীয় মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজেস (এমএসএমই)-এর মধ্যে সফল সহযোগিতার ফল। এই কমিশনিংয়ের মাধ্যমে নৌবাহিনী তার হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভে ক্ষমতাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে, যা সমুদ্রপথে নিরাপদ নেভিগেশন এবং মেরিটাইম ডোমেইন অ্যাওয়ারনেসকে শক্তিশালী করবে।
আইএনএস ইক্ষাকের নামের অর্থ ‘দ্য গাইড’—যা তার মিশনকে পুরোপুরি প্রতিফলিত করে। এই জাহাজ অজানা সমুদ্রের গভীরতা ম্যাপিং করে নাবিকদের নিরাপদ পথ দেখাবে এবং ভারতের মেরিটাইম শক্তিকে আরও মজবুত করবে। এটি এসভিএল শ্রেণির চতুর্থ জাহাজের মধ্যে তৃতীয়টি; প্রথমটি আইএনএস সন্ধ্যাক ২০২৪-এর ফেব্রুয়ারিতে এবং দ্বিতীয়টি আইএনএস নির্দেশক ডিসেম্বরে কমিশন হয়েছে। ২০১৮ অক্টোবরে চারটি জাহাজের জন্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, এবং এই প্রকল্পটি নৌবাহিনীর আন্দাজনিক প্ল্যাটফর্ম গড়ার প্রতিশ্রুতিকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেছে। জাহাজটির বিল্ডিংয়ে ডিরেক্টরেট অফ শিপ প্রোডাকশন এবং ওয়ারশিপ ওভারসিইং টিম (কলকাতা)-এর তত্ত্বাবধানে কাজ হয়েছে, যা দেশীয় শিল্পের সাথে নৌবাহিনীর অটুট বন্ধনকে তুলে ধরে।
জাহাজটির প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্যগুলো সত্যিই অসাধারণ। প্রায় ৩,৪০০ টন ওজনের এই জাহাজটির দৈর্ঘ্য ১১০ মিটার, এবং এতে স্টেট-অফ-দ্য-আর্ট হাইড্রোগ্রাফিক সরঞ্জাম রয়েছে—যেমন ডেটা অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড প্রসেসিং সিস্টেম, অটোনোমাস আন্ডারওয়াটার ভেহিকল, রিমোটলি অপারেটেড ভেহিকল, ডিজিপিএস লং রেঞ্জ পজিশনিং সিস্টেম এবং ডিজিটাল সাইড স্ক্যান সোনার। দুটি ডিজেল ইঞ্জিনে চালিত এটি ১৮ নটের বেশি গতিতে চলতে পারে, এবং ১৪-১৬ নটে ৬,৫০০ নটিক্যাল মাইলের রেঞ্জ কভার করতে সক্ষম। এতে চারটি সার্ভে মোটরবোট এবং একটি অ্যাডভান্সড লাইট হেলিকপ্টারের জন্য হ্যাঙ্গার রয়েছে, যা সমুদ্রের উপকূলীয় এবং গভীর জলের সার্ভে অপারেশনকে সহজ করে। ২৩১ জন কর্মীর জন্য জায়গা রয়েছে, এবং আন্তর্জাতিক মেরিন পলিউশন স্ট্যান্ডার্ডস (মারপোল) মেনে চলা হয়েছে। এছাড়া, সেকেন্ডারি রোলে এটি সিআরএন ৯১ নেভাল গান ফিট করে মিলিটারি অপারেশনেও ব্যবহারযোগ্য।
কিন্তু আইএনএস ইক্ষাকের সবচেয়ে বিশেষ দিক হলো এর মাল্টি-রোল ক্যাপাবিলিটি। হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভের পাশাপাশি এটি হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যান্ড ডিজাস্টার রিলিফ (এইচএডিআর) প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করতে পারে এবং জরুরি অবস্থায় হাসপাতাল জাহাজে রূপান্তরিত হতে সক্ষম। এটি দুর্যোগকালীন চিকিত্সা সহায়তা, উদ্ধার অভিযান এবং উপকূলীয় অঞ্চল বা দ্বীপপুঞ্জে সাহায্য প্রদানে অমূল্য ভূমিকা পালন করবে। আরও একটা ইতিবাচক পদক্ষেপ হলো এটি এসভিএল শ্রেণির প্রথম জাহাজ যাতে মহিলা অফিসার এবং সেলরদের জন্য আলাদা থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। এতে নৌবাহিনীর অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছে, যা একটি ভবিষ্যৎ-প্রস্তুত, লিঙ্গ-সমন্বিত ফ্লিট গড়ার লক্ষ্যকে সাকার করছে।
এই কমিশনিং শুধু একটা জাহাজ যোগ করা নয়, এটি ভারতের নৌ-নির্মাণ ক্ষমতার একটা মাইলফলক। আত্মনির্ভর ভারতের চেতনায় দেশীয় শিল্পের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে এটি আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে মেরিটাইম স্বনির্ভরতাকে বাড়িয়ে তুলছে। কলকাতার জিআরএসই-এর মতো পাবলিক সেক্টর ইউনিট এবং ছোট-বড় এমএসএমই-এর যৌথ প্রয়াসে এমন জটিল মেরিটাইম প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়েছে, যা লক্ষ লক্ষ যুবকদের জন্য অনুপ্রেরণা। এর ফলে নৌবাহিনী সমুদ্রের অজানা অঞ্চলগুলোকে ম্যাপ করে নিরাপত্তা এবং নেভিগেশনকে নিশ্চিত করতে পারবে, যা আঞ্চলিক মেরিটাইম নিরাপত্তাকেও শক্তিশালী করবে। সারা দেশে এই খবরে উৎসাহের ঢেউ উঠেছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় #INSIkshak এবং #AatmanirbharNavy ট্রেন্ড করছে। ভারত মাতা কি জয় হো—এই জয় ভবিষ্যতের জন্য একটা নির্ভরযোগ্য গাইড হয়ে উঠবে!
