ভারত তার প্রতিরক্ষা ক্ষমতাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। রক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা (DRDO)-এর হায়দ্রাবাদ-ভিত্তিক অ্যাডভান্সড নেভাল সিস্টেমস ল্যাবরেটরি (এএনএসএল) দ্বারা তৈরি কে-৬ হাইপারসনিক মিসাইল (K-6 Hypersonic Missile) প্রথম সমুদ্র পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত। এই সাবমেরিন-লঞ্চড ব্যালিস্টিক মিসাইল (এসএলবিএম) তার অতুলনীয় গতি, পরিসর এবং গোপনীয়তার কারণে ভারতের কৌশলগত প্রতিরক্ষায় একটি যুগান্তকারী অস্ত্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কে-৬ মিসাইলটি ভারতের আগামী এস-৫ শ্রেণির পারমাণবিক সাবমেরিনে মোতায়েনের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, যা বর্তমান অরিহান্ত শ্রেণির তুলনায় বৃহত্তর এবং আরও শক্তিশালী। এই মিসাইলটি শীঘ্রই সমুদ্র পরীক্ষার মাধ্যমে ভারতকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশগুলির মধ্যে একটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে, যারা উন্নত সমুদ্র-ভিত্তিক পারমাণবিক আক্রমণ ক্ষমতা সম্পন্ন।
কে-৬ মিসাইলের বৈশিষ্ট্য
কে-৬ মিসাইলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এর হাইপারসনিক গতি। এটি রি-এন্ট্রি পর্যায়ে ম্যাক ৭.৫ গতি অর্জন করতে পারে, যা প্রায় ৯,২০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা। এর পরিসর প্রায় ৮,০০০ কিলোমিটার, যা এটিকে শত্রুপক্ষের গভীর অঞ্চলে কয়েক মিনিটের মধ্যে আঘাত হানতে সক্ষম করে। এটি ভারতের বর্তমান এসএলবিএম যেমন কে-৪ (৩,৫০০ কিমি) এবং কে-৫ (৬,০০০ কিমি) থেকে অনেক এগিয়ে। এই মিসাইলটি মাল্টিপল ইন্ডিপেন্ডেন্টলি টার্গেটেবল রি-এন্ট্রি ভেহিকল (এমআইআরভি) প্রযুক্তি দিয়ে সজ্জিত, যা একটি একক মিসাইলকে একাধিক লক্ষ্যবস্তুতে উচ্চ নির্ভুলতার সঙ্গে আঘাত করতে সক্ষম করে। এই প্রযুক্তি ভারতের আক্রমণাত্মক এবং প্রতিরক্ষামূলক কৌশলগত নমনীয়তা বাড়ায়।
গোপনীয়তা এবং কৌশলগত প্রতিরোধ
কে-৬ মিসাইলের হাইপারসনিক গতি এবং চালনা ক্ষমতা এটিকে প্রচলিত অ্যান্টি-মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জVএর জন্য অত্যন্ত কঠিন করে তোলে। এর গতি এবং গোপনীয়তা শত্রুপক্ষের প্রতিক্রিয়ার সময়কে প্রায় শূন্যে নামিয়ে আনে। এটি পারমাণবিক বা প্রচলিত ওয়ারহেড বহন করতে পারে, যা ভারতের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে নতুন মাত্রা দেয়। এই মিসাইলটি ভারতের নৌ-ভিত্তিক পারমাণবিক প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করবে, বিশেষ করে সম্ভাব্য প্রতিপক্ষ যেমন পাকিস্তান এবং চীনের বিরুদ্ধে।
এস-৫ শ্রেণির সাবমেরিনের জন্য ডিজাইন
কে-৬ মিসাইলটি ভারতের আগামী এস-৫ শ্রেণির পারমাণবিক সাবমেরিনের জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছে। এই সাবমেরিনগুলি অরিহান্ত শ্রেণির তুলনায় দ্বিগুণ বড়, প্রায় ১৩,৫০০ টন ওজনের, এবং ১৯০ মেগাওয়াট রিঅ্যাক্টর দ্বারা চালিত। এই সাবমেরিনগুলি ১৬টি কে-৬ মিসাইল বহন করতে পারবে, যা ভারতের সমুদ্র-ভিত্তিক পারমাণবিক ত্রিভুজকে (ল্যান্ড, এয়ার এবং সি) আরও শক্তিশালী করবে। এস-৫ শ্রেণির সাবমেরিনগুলির নির্মাণ ২০২৭ সালের মধ্যে শুরু হবে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতীয় নৌবাহিনীতে যুক্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই সাবমেরিনগুলি উন্নত গোপনীয়তা বৈশিষ্ট্য এবং ভারী ওয়ারহেড বহনের ক্ষমতা দিয়ে সজ্জিত হবে।
ব্রহ্মোসের তুলনায় উন্নত ক্ষমতা
কে-৬ মিসাইলটি ভারতের বিখ্যাত ব্রহ্মোস সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইলের তুলনায় গতি, ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা এবং পরিসরে অনেক এগিয়ে। ব্রহ্মোসের তুলনায় কে-৬-এর গতি ম্যাক ৭.৫, যা এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুততম মিসাইলগুলির মধ্যে একটি করে তোলে। এর এমআইআরভি প্রযুক্তি এটিকে একাধিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার ক্ষমতা দেয়, যা ব্রহ্মোসের একক-লক্ষ্য ক্ষমতার তুলনায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি। এছাড়া, এর ৮,০০০ কিলোমিটার পরিসর ব্রহ্মোসের ৪০০-৬০০ কিলোমিটার পরিসরের তুলনায় অনেক বেশি, যা এটিকে ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল (আইসিবিএম) হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করে।
আত্মনির্ভর ভারতের জন্য মাইলফলক
কে-৬ মিসাইলের সমুদ্র পরীক্ষা ভারতের প্রতিরক্ষা স্বনির্ভরতার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই মিসাইলটি সম্পূর্ণরূপে ভারতীয় প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি, যা ‘আত্মনির্ভর ভারত’ উদ্যোগের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। ডিআরডিওর অ্যাডভান্সড সিস্টেমস ল্যাবরেটরিতে এই মিসাইলের উন্নয়ন ২০১৭ সালে শুরু হয়েছিল, এবং এটি ২০৩০ সালের মধ্যে পুরোপুরি কার্যকর হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই মিসাইলটি ভারতের নৌবাহিনীকে কৌশলগত এবং পারমাণবিক উভয় ধরনের শক্তি প্রদান করবে।
বিশ্ব মঞ্চে ভারতের অবস্থান
কে-৬ মিসাইলের সফল পরীক্ষা ভারতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যের মতো অল্প কয়েকটি দেশের পাশে নিয়ে যাবে, যারা হাইপারসনিক এবং এমআইআরভি-সজ্জিত মিসাইল ক্ষমতা সম্পন্ন। এই মিসাইলটি ভারতের সমুদ্র-ভিত্তিক পারমাণবিক ত্রিভুজকে শক্তিশালী করবে, যা ভারতের ‘নো ফার্স্ট ইউজ’ নীতির আলোকে দ্বিতীয় আক্রমণ ক্ষমতাকে আরও নির্ভরযোগ্য করে তুলবে। এটি ভারতের সমুদ্র সীমানা এবং কৌশলগত স্বার্থ রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
কে-৬ মিসাইল এবং এস-৫ সাবমেরিনের উন্নয়ন ভারতের জন্য একটি জটিল এবং ব্যয়বহুল প্রকল্প। অরিহান্ত শ্রেণির সাবমেরিনগুলির তুলনায় এস-৫ শ্রেণির সাবমেরিনগুলির নকশা এবং নির্মাণে উন্নত প্রযুক্তি এবং উচ্চ ব্যয় জড়িত। তবে, ভারতীয় শিল্প, যেমন স্টিল অথরিটি অব ইন্ডিয়া, এই প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এছাড়া, কে-৬ মিসাইলের পরীক্ষা এবং এর সফল মোতায়েন ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন ক্ষমতার একটি প্রমাণ।
কে-৬ হাইপারসনিক মিসাইল ভারতের প্রতিরক্ষা ক্ষমতার একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করছে। এটি কেবল একটি আপগ্রেড নয়, বরং ভারতের কৌশলগত প্রতিরোধ ক্ষমতাকে পুনর্নির্ধারণ করছে। এর সমুদ্র পরীক্ষা ভারতের উচ্চ-প্রযুক্তির প্রতিরক্ষা উদ্ভাবনের ক্ষমতাকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরবে। ভারতের নৌবাহিনী এবং ডিআরডিওর এই প্রচেষ্টা ভারতকে একটি শক্তিশালী নৌ-ভিত্তিক পারমাণবিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে, যা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা এবং কৌশলগত স্বার্থ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।