ভারত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ও ব্যস্ততম রেল নেটওয়ার্কের দেশ। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ যাত্রী ট্রেনে ভ্রমণ করেন—কেউ নিজের খাবার সঙ্গে আনেন, কেউ বা নির্ভর করেন রেলওয়ে ক্যান্টিনের উপর। তবে এই দীর্ঘ রেল ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে একটি বিশেষ ট্রেন৷ সচখণ্ড এক্সপ্রেস। এই ট্রেনে যাত্রীরা কেবল সফরই করেন না, উপভোগ করেন গরম-গরম, সদ্য প্রস্তুত খাবারের স্বাদ৷ তাও আবার বিনামূল্যে৷
ইতিহাস ও তাৎপর্য
সচখণ্ড এক্সপ্রেস (ট্রেন নং 12715) মহারাষ্ট্রের নান্দেড থেকে পঞ্জাবের অমৃতসর পর্যন্ত চলে। এর পথ গভীর আধ্যাত্মিকতায় আবৃত। নান্দেডে অবস্থিত দশম শিখ গুরু শ্রী গুরু গোবিন্দ সিং জি-র সমাধিক্ষেত্র, আর অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির (হরমন্দির সাহিব) শিখ ধর্মের সর্বাধিক পবিত্র তীর্থক্ষেত্র। তাই এই ট্রেনকে শুধু পরিবহণ নয়, এক অর্থে ‘চলমান তীর্থযাত্রা’ হিসেবেই দেখা হয়।
এই বিশেষ সেবা শুরু হয়েছিল নব্বইয়ের দশকে, প্রায় তিন দশক আগে। তারপর থেকে লক্ষ লক্ষ ভক্ত ও তীর্থযাত্রী এই ট্রেনে ভ্রমণ করেছেন এবং উপভোগ করেছেন লঙ্গর—যা শিখ ধর্মের সমতা, দানশীলতা ও নিঃস্বার্থ সেবার প্রতীক।
যাত্রাপথ ও খাবার সেবা
প্রায় ২,০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথে নির্ধারিত ৩৯টি স্টপেজ রয়েছে। তবে মূলত নয়াদিল্লি, ভোপাল, পারভানি, জলনা, ঔরঙ্গাবাদ ও মারাঠওয়াড়া—এই ছয়টি স্টেশনে থেমে যাত্রীদের খাবার পরিবেশন করা হয়। প্রায় ৩৩ ঘণ্টার যাত্রায় যাত্রীরা বিনামূল্যে তিন বেলা—প্রাতরাশ, মধ্যাহ্নভোজ ও রাতের খাবার পান।
এই লঙ্গর সেবা সম্পূর্ণভাবে পরিচালিত হয় বিভিন্ন গুরুদোয়ারার অনুদান ও দানের মাধ্যমে। শতাব্দীপ্রাচীন শিখ লঙ্গরের ঐতিহ্য অনুযায়ী, এখানে ধর্ম, জাত, শ্রেণি বা অবস্থান নির্বিশেষে সকলকে একই খাবার পরিবেশন করা হয়। সচখণ্ড এক্সপ্রেসেও সেই নীতি বজায় রেখে জেনারেল ক্লাস থেকে শুরু করে এসি কোচ—প্রত্যেক যাত্রী একই খাবার পান।
খাবারের ধরন
খাবার সাধারণ হলেও পুষ্টিকর ও সুস্বাদু—ডাল, ছোলে, খিচুড়ি, আলু বা ফুলকপির তরকারি ইত্যাদি সহজপাচ্য পদই এখানে পরিবেশন করা হয়। যাত্রীদের নিজেদের পাত্র সঙ্গে আনার পরামর্শ দেওয়া হয়, যাতে পরিচ্ছন্নতা বজায় থাকে ও খাদ্য অপচয় কম হয়।
বুকিং প্রক্রিয়া
সচখণ্ড এক্সপ্রেসে যাত্রা করতে চাইলে সাধারণ নিয়মে রেলের অনলাইন বুকিং সিস্টেমের মাধ্যমে টিকিট করতে হয়। প্রয়োজনে নির্দিষ্ট পোর্টালে লগইন করে আবেদনপত্র পূরণ করতে হয়। যাত্রীদের ছবি, স্বাক্ষর ও প্রয়োজনীয় নথি আপলোড করতে হয়। ফি জমা দিলেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। ভবিষ্যতের জন্য পূর্ণাঙ্গ ফর্মের একটি কপি সংরক্ষণ করাই উত্তম।
ট্রেন নয়, চলমান তীর্থযাত্রা
সচখণ্ড এক্সপ্রেস শুধু এক শহর থেকে অন্য শহরে পৌঁছে দেওয়া পরিবহণ নয়—এটি বিশ্বাস, সেবা ও মানবিকতার এক অনন্য অভিজ্ঞতা। যাত্রীরা শুধু গন্তব্যে পৌঁছান না, বরং প্রত্যক্ষ করেন শিখ ধর্মের দানশীলতা ও সমতার বার্তা। বহু ভ্রমণকারীর কাছে এই অভিজ্ঞতা আজীবন স্মৃতিমধুর হয়ে থাকে।