মৃত্যুর পথ থেকে সুখের সংসার, HIV-কে হারিয়ে ভারতীয় দম্পতির স্বপ্ন-সফর

মৃত্যু, মানুষের জীবনের চরম সত্য। মধু কবির ভাষায় “জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কথা কবে (HIV)।” তবে কখনো মৃত্যুও হার মেনে যায় জীবনের কাছে। বেঁচে…

HIV couples are having happy life

মৃত্যু, মানুষের জীবনের চরম সত্য। মধু কবির ভাষায় “জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কথা কবে (HIV)।” তবে কখনো মৃত্যুও হার মেনে যায় জীবনের কাছে। বেঁচে থাকবার দূর্ণিবার ইচ্ছে মানুষকে নিয়ে মৃত্যুর পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে এক অনন্ত জীবনের পথে। ঠিক যেমন তরুণ আর অনুষ্কা (পরিবর্তিত নাম )। এই দুই এইচআইভি আক্রান্ত মানুষের ইচ্ছে শক্তির কাছে হার মেনেছে মৃত্যু। সমস্ত রকম সামাজিক বাধা দূরে ঠেলে তারা ভেসে চলেছে এই জীবন নদীতে।

মুম্বইয়ের বাসিন্দা তরুনের ২০০২ সালে এইচআইভি পজিটিভ ধরা পড়ে। ডাক্তার তাকে বলেছিলেন তার আয়ু মাত্র ৩০ দিন। তখন এইচআইভি ধরা পড়া মানেই ছিল সাক্ষাৎ মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়া। সমাজের তিরস্কার এবং মানসিক যন্ত্রণা প্রায়ই মৃত্যুর আগেই আক্রান্তদের মানসিক ভাবে ভেঙে দিত।

   

কিন্তু তরুন এই প্রতিকূলতাকে মানতে চাইনি। গত ২৩ বছর ধরে এইচআইভি নিয়ে প্রায় স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন তিনি। অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি (এআরটি), পরিবারের সমর্থন এবং সহকর্মীদের সাপোর্টে তিনি এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন।

বর্তমানে ৪৬ বছর বয়সী তরুণ সুস্থ এবং বিবাহিত। তরুণ নিজেই বলছেন, তিনি একটি “পূর্ণ জীবন” যাপন করছেন। তাঁর স্ত্রী অনুষ্কা ও এইচআইভি পজিটিভ। তাদের একটি কন্যা, আছে যে এইচআইভি নেগেটিভ, এবং একটি দত্তক পুত্র রয়েছে।

ভারতে এইচআইভি: পরিসংখ্যান ও পরিবর্তন

ন্যাশনাল এইডস কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন (ন্যাকো)-র ২০১৯ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে প্রায় ২৩.৪৮ লক্ষ মানুষ এইচআইভি নিয়ে বসবাস করছেন, যা বিশ্বে তৃতীয় সর্বোচ্চ। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে এই সংখ্যা ২.৫ থেকে ৩ মিলিয়নের মধ্যে, যার এক-তৃতীয়াংশ ২১-৩৫ বছর বয়সী বিয়ের উপযুক্ত গ্রুপে রয়েছে।

নাজ ফাউন্ডেশন (ইন্ডিয়া) ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক অঞ্জলি গোপালন বলেন, “এক দশক আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি এইচআইভি পজিটিভ ব্যক্তি বিয়ে করছেন। এমনকি এইচআইভি পজিটিভ ব্যক্তিরা এইচআইভি নেগেটিভ ব্যক্তিদের সঙ্গেও বিয়ে করছেন।” মুম্বইয়ের হুমসফর ট্রাস্টের অ্যাডভোকেসি অফিসার সুমি এমকে জানান, এইচআইভি পজিটিভ ব্যক্তিদের মধ্যে বিবাহের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।

এইচআইভি পজিটিভদের জন্য বিবাহের পথএইচআইভি পজিটিভ ব্যক্তিদের জন্য জীবনসঙ্গী খুঁজে পাওয়ার পদ্ধতিও বদলাচ্ছে। এইচআইভিপরিচয়.কম এবং পজিটিভসাথী.কম-এর মতো এইচআইভি-নির্দিষ্ট অনলাইন ম্যাট্রিমনি প্ল্যাটফর্ম উঠে এসেছে।

এমনকি জীবনসাথী.কম-এর মতো জনপ্রিয় ম্যাট্রিমনি প্ল্যাটফর্মও এইচআইভি পজিটিভ ব্যক্তিদের জন্য একটি বিশেষ বিভাগ চালু করেছে। তবে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ মানুষ এখনও ন্যাকো আয়োজিত বার্ষিক মিলনমেলার মাধ্যমে জীবনসঙ্গী খুঁজে পান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এই মেলাগুলিতে কিছুটা ভূমিকা পালন করে।

Advertisements

অবশেষে কলকাতায় পা রাখলেন হামিদ আহাদাদ

তরুনের যাত্রা

তরুন, একজন শেফ হিসেবে ক্রুজ-লাইনারের চাকরি করতেন। সেখান থেকে ফিরে মুম্বইয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর তার এই রোগ ধরা পড়ে। ভয় পেয়ে তিনি নয় মাস ধরে তাঁর মাকে এই খবর লুকিয়েছিলেন। ডাক্তার তাঁকে ৩০ দিনের সময় দিয়েছিলেন, কিন্তু মায়ের সমর্থন তাঁকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে।

ওষুধ, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং নিয়মিত চেকআপ তাঁর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং মানসিকতাকে শক্তিশালী করে। রান্নাঘরে আঘাতের ভয়ে তিনি শেফের চাকরি ছেড়ে কল সেন্টারে কাজ শুরু করেন এবং পরে পিয়ার কাউন্সেলর হন। একদিন, রায়পুরের এক এইচআইভি পজিটিভ মহিলার সঙ্গে তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, যিনি পরে তাঁর জীবন সঙ্গিনী হয়েছেন ।

এইচআইভি পজিটিভ দম্পতি ও নিরাপদ সন্তান জন্ম

তরুন এবং অনুষ্কার বিবাহের পর সন্তানের জন্ম দেওয়া ছিল তাদের পরবর্তী বড় চ্যালেঞ্জ।তরুন বলেন, “আমরা দুজনেই এইচআইভি পজিটিভ হওয়ায় অনেক হাসপাতাল আমাদের ফিরিয়ে দিয়েছিল।” তাদের ভুলভাবে বলা হয়েছিল যে তারা এইচআইভি নেগেটিভ সন্তান জন্ম দিতে পারবেন না।

ডাঃ রশ্মি সিং, একজন দিল্লি-ভিত্তিক চিকিৎসক, জানান, “যদি মায়ের ভাইরাল লোড নিয়ন্ত্রিত থাকে, তবে সন্তানের মধ্যে সংক্রমণের ঝুঁকি ১%-এরও কম।” সিজারিয়ান ডেলিভারি এবং জন্মের পর শিশুকে প্রতিরোধমূলক ওষুধ দেওয়া হয়। তরুন এবং অনুষ্কা গাইনোকোলজিস্টের তত্ত্বাবধানে পরিকল্পিতভাবে সন্তান নিয়েছেন।

এইচআইভি নিয়ে দাম্পত্য জীবন

এইচআইভি পজিটিভ দম্পতিদের অরক্ষিত যৌনতার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। তারুণ বলেন, তিনি এবং অনুষ্কা তাঁদের গর্ভধারণ পরিকল্পিতভাবে করেছেন, কারণ তাঁর ভাইরাল লোড নিয়ন্ত্রিত থাকলেও অনুষ্কার সিডি৪ কাউন্টে প্রভাব পড়তে পারে। ভারতের এআরটি প্রোগ্রাম বিশ্বের সবচেয়ে সাশ্রয়ী এবং সহজলভ্য, যেখানে ন্যাকো বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ করে।

এইচআইভি নিয়ে জীবনযাপন আজ আর অসম্ভব নয়। তারুণের গল্প এইচআইভি পজিটিভ ব্যক্তিদের জন্য নতুন সম্ভাবনার প্রতীক। ন্যাকোর মিলনমেলা, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এবং সহকর্মীদের সমর্থন তাদের জীবনসঙ্গী খুঁজে পেতে সাহায্য করছে। তবে, সামাজিক কুসংস্কার এবং শিক্ষার অভাব এখনও চ্যালেঞ্জ। তরুনের মত ব্যক্তিরা প্রমাণ করছেন যে এইচআইভি নিয়েও একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনের দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।