ভারতীয় সেনাবাহিনী মায়ানমারের সাগাইং অঞ্চলে চিন-সমর্থিত ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ আসম-ইন্ডিপেন্ডেন্ট (ULFA-I) এবং ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অফ নাগাল্যান্ড-খাপলাং (NSCN-K) এর জঙ্গি ক্যাম্পগুলির উপর বড় ধরনের ড্রোন হামলা (Indian Army Drone Strikes) চালিয়েছে। রবিবার ভোরে পরিচালিত এই অভিযানে ULFA-I-এর পূর্ব কমান্ড সদর দফতর ধ্বংস করা হয়েছে এবং একাধিক শীর্ষ কমান্ডার নির্মূল হয়েছেন। এই অভিযান ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বার্তা পাঠিয়েছে, যা চিনের মদদপুষ্ট জঙ্গি কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের ইঙ্গিত দেয়।
অভিযানের বিস্তারিত
সাম্প্রতিক গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ভারতীয় সেনাবাহিনী মায়ানমারের সাগাইং অঞ্চলে অবস্থিত ULFA-I এবং NSCN-K এর ক্যাম্পগুলির উপর নির্ভুল ড্রোন হামলা চালায়। এই ক্যাম্পগুলি দীর্ঘদিন ধরে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে জঙ্গি কার্যকলাপের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। অভিযানে প্রায় ১০০টি ড্রোন ব্যবহার করা হয়, যা ক্যাম্পগুলিকে ধ্বংস করে এবং একাধিক শীর্ষ জঙ্গি নেতাকে নির্মূল করে। ULFA-I-এর পূর্ব কমান্ড সদর দফতর, যা সংগঠনের কার্যক্রমের একটি প্রধান কেন্দ্র ছিল, এই হামলায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়।
এই অভিযানটি ভারতের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে “জিরো টলারেন্স” নীতির একটি প্রতিফলন। সূত্রের মতে, এই হামলা ভারত-মায়ানমার সীমান্তে জঙ্গিদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল ধ্বংস করার জন্য পরিকল্পিত এবং নির্ভুলভাবে সম্পাদিত হয়েছে। এই অভিযানে কোনো সাধারণ নাগরিকের ক্ষতি হয়নি, যা ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং নির্ভুলতার প্রমাণ দেয়।
চিনের ভূমিকা ও ভারতের জবাব
এই জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির পিছনে চিনের সমর্থন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাহুল আর সিং সম্প্রতি জানিয়েছেন যে, চিন পাকিস্তানের সঙ্গে মিলে ভারতের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করছে এবং জঙ্গি কার্যকলাপে মদদ দিচ্ছে। এই অভিযানের মাধ্যমে ভারত স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে যে, চিন-সমর্থিত জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির কোনো নিরাপদ আশ্রয়স্থল থাকবে না।
ULFA-I এবং NSCN-K দীর্ঘদিন ধরে ভারত-মায়ানমার সীমান্তের সুবিধা নিয়ে অস্ত্র প্রশিক্ষণ, বিস্ফোরক তৈরি এবং জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা করে আসছিল। এই গোষ্ঠীগুলি উত্তর-পূর্ব ভারতের নাগাল্যান্ড, মণিপুর এবং আসামে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জন্য দায়ী। ২০১৫ সালে NSCN-K এর নেতা এসএস খাপলাং ভারতের সঙ্গে ১৪ বছরের যুদ্ধবিরতি বাতিল করার পর থেকে এই গোষ্ঠীগুলি আরও সক্রিয় হয়ে ওঠে।
অভিযানের তাৎপর্য
এই ড্রোন হামলা ভারতের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির একটি প্রমাণ। অতীতে, ২০১৫ সালের জুন মাসে ভারতীয় সেনাবাহিনী “অপারেশন হট পারসুট” নামে একটি অভিযান চালিয়েছিল, যেখানে NSCN-K এর ক্যাম্পগুলি ধ্বংস করা হয়েছিল। এবারের অভিযানটি আরও উন্নত প্রযুক্তি এবং গোয়েন্দা তথ্যের উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়েছে।
এই অভিযানের ফলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ULFA-I এবং NSCN-K এর মতো জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির কার্যক্রম দীর্ঘদিন ধরে আসাম, নাগাল্যান্ড এবং মণিপুরে নিরাপত্তা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই হামলার মাধ্যমে ভারতীয় সেনাবাহিনী স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, সীমান্তের ওপারে জঙ্গিদের কোনো নিরাপদ আশ্রয় থাকবে না।
রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাব
এই অভিযান মায়ানমারের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কের উপরও প্রভাব ফেলতে পারে। মায়ানমারের চলমান গৃহযুদ্ধ এবং সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে সংঘর্ষের কারণে সীমান্ত অঞ্চলটি ইতিমধ্যেই অস্থিতিশীল। ভারতের এই অভিযান মায়ানমারের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে কিনা, তা নিয়ে এখনও স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে, এই ধরনের অভিযান ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি অঙ্গীকারকে আরও জোরালো করে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই ড্রোন হামলা কেবলমাত্র ULFA-I এবং NSCN-K এর মতো জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির বিরুদ্ধে একটি কৌশলগত জয় নয়, বরং চিনের মতো বিদেশি শক্তির মদদপুষ্ট সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের দৃঢ় অবস্থানের প্রমাণ। এই অভিযান উত্তর-পূর্ব ভারতের নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এবং সীমান্ত অঞ্চলে জঙ্গি কার্যকলাপকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সাহায্য করবে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই সাফল্য জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে।