ট্রাম্পের ৫০% শুল্ক বোমা! কোন কোন ভারতীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত, কোন খাত রইল নিরাপদ?

India-US trade war নয়াদিল্লি: ভারত-মার্কিন বাণিজ্য সম্পর্কের ইতিহাসে জোড় ধাক্কা। বুধবার ভোর থেকে কার্যকর হল ওয়াশিংটনের নতুন শুল্কনীতি, যার ফলে ভারতীয় পণ্যের উপর আরোপিত শুল্ক…

India-US trade war

India-US trade war

নয়াদিল্লি: ভারত-মার্কিন বাণিজ্য সম্পর্কের ইতিহাসে জোড় ধাক্কা। বুধবার ভোর থেকে কার্যকর হল ওয়াশিংটনের নতুন শুল্কনীতি, যার ফলে ভারতীয় পণ্যের উপর আরোপিত শুল্ক এক লাফে দাঁড়াল ৫০ শতাংশে। ইতিমধ্যেই ঘোষিত ২৫ শতাংশ শুল্কের সঙ্গে আরও ২৫ শতাংশ যোগ করে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছে মার্কিন প্রশাসন। হোমল্যান্ড সিকিউরিটির বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, ভারত থেকে আমদানিকৃত যে কোনও পণ্য আজ ভোর ৯টা ৩১ মিনিট (ভারতীয় সময়) থেকে এই উচ্চশুল্কের আওতায় পড়বে।

ভূরাজনীতির প্রতিধ্বনি বাণিজ্যে

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাশিয়া-সংযুক্ত দেশগুলির বিরুদ্ধে চলা ‘শুল্ক অভিযান’-এর লক্ষ্যবস্তু এবার ভারত। কারণ, নয়াদিল্লি এখনও রাশিয়ান অপরিশোধিত তেলের অন্যতম বড় ক্রেতা। এই পদক্ষেপে ক্ষোভ উগরে দিয়েছে নয়াদিল্লি, সমর্থন দিয়েছে মস্কো। ক্রেমলিন স্পষ্ট জানিয়েছে— কোন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্ণ অধিকার ভারতের রয়েছে।

   

রপ্তানিতে বিপুল আঘাত India-US trade war

গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ (GTRI)-এর অনুমান অনুযায়ী, ভারতের মোট রপ্তানি ৮৬.৫ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে প্রায় ৬০.২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য সরাসরি পড়বে এই নতুন শুল্কের আওতায়। সরকারি হিসাবে ক্ষতির অঙ্ক খানিকটা কম হলেও, তা প্রায় ৪৮.২ বিলিয়ন ডলার। যদি এই নীতি অব্যাহত থাকে, তবে আগামী অর্থবছরেই ভারতের রপ্তানি কমে নেমে আসবে ৪৯.৬ বিলিয়ন ডলারে, যা কার্যত পাঁচ বছরের প্রবৃদ্ধির ধারা বিপর্যস্ত করবে।

সবচেয়ে বেশি বিপন্ন খাত

ভারতের শ্রমনির্ভর শিল্প সবচেয়ে বড় ধাক্কার মুখে—

টেক্সটাইল ও রেডিমেড পোশাক: মার্কিন বাজারে বার্ষিক রফতানি ১০.৮ বিলিয়ন ডলার। নতুন শুল্কে কার্যকর হার দাঁড়াচ্ছে ৬৩.৯ শতাংশ। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। তিরুপ্পুর ক্লাস্টার— যা একাই ভারতের ৩০ শতাংশ পোশাক রফতানি নিয়ন্ত্রণ করে এবং ৬ লক্ষ শ্রমিকের জীবিকা নির্ভর করে এই শিল্পে— পড়বে ভয়াবহ সংকটে।

রত্ন ও গয়না: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৯.৯৪ বিলিয়ন ডলারের রফতানির উপর এখন কার্যকর শুল্ক ৫২.১ শতাংশ। ইতিমধ্যেই সুরাটে হিরে প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে অর্ডার স্থগিত ও শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হয়েছে।

চিংড়ি ও সামুদ্রিক খাদ্য: ভারতের সামুদ্রিক খাদ্যের অর্ধেক রফতানি যায় মার্কিন বাজারে, যার মূল্য প্রায় ২.৪ বিলিয়ন ডলার। নতুন শুল্কে কার্যকর হার দাঁড়াচ্ছে ৬০ শতাংশ। রফতানিকারকরা সতর্ক করছেন— ইকুয়েডরের মতো দেশ, যাদের উপর মাত্র ১৫ শতাংশ শুল্ক, বাজার দখল করে নেবে।

কার্পেট, ফার্নিচার ও হোম টেক্সটাইল: ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে ভারতের কার্পেট রফতানি দাঁড়িয়েছিল প্রায় ১.২ বিলিয়ন ডলার। এবার তার উপর পড়ছে কার্যকরী ৫২.৯ শতাংশ শুল্কের বোঝা। এমনিতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রাস্ফীতির চাপে গৃহসজ্জার সামগ্রীর চাহিদা কমেছে। নতুন এই শুল্কপ্রাচীর ক্রেতাদের আরও বেশি করে তুরস্ক বা ভিয়েতনামের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য করতে পারে।

চামড়াজাত পণ্য ও ফুটওয়্যার: চামড়ার পণ্য ও জুতোর উপরও সরাসরি ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ হয়েছে। কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি ও লজিস্টিকস খরচের চাপে আগে থেকেই নাজেহাল এই শিল্পে যুক্ত হলো নতুন ধাক্কা। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকাই কঠিন হয়ে উঠবে ভারতীয় নির্মাতাদের জন্য।

অটো কম্পোনেন্টস:

২০২৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের অটো কম্পোনেন্ট রফতানি ছিল প্রায় ৬.৬ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ছোট গাড়ি ও ট্রাকের যন্ত্রাংশসহ ৩.৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য ২৫ শতাংশ শুল্কে পড়লেও, বাকি অংশের উপর সরাসরি ৫০ শতাংশ শুল্ক বসানো হয়েছে। ফলে পুরো সেক্টরটি বড় ধরনের ধাক্কার মুখে।

কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য:

বাসমতী চাল, চা, মসলা ও অন্যান্য কৃষিজ পণ্য—যার রফতানি মূলধন প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার—এবার পড়ল পূর্ণ ৫০ শতাংশ শুল্কের আওতায়। ভারতের সবচেয়ে বড় রফতানি খাত বাসমতী চালের উপর এই শুল্ক বৃদ্ধি মার্কিন বাজারে থাইল্যান্ড ও পাকিস্তানের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলিকে বাড়তি সুবিধা দেবে। একইভাবে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের উপর উচ্চ শুল্ক ভারতীয় রফতানিকারকদের জন্য নতুন করে বড়সড় বাজার সংকট তৈরি করবে।

আশঙ্কার কালো মেঘ

শিল্পবিশেষজ্ঞদের মতে, এই শুল্কপ্রাচীর শুধু রফতানির অঙ্ক নয়, ভারতের শ্রমনির্ভর শিল্পের ভবিষ্যত, কর্মসংস্থান এবং বৈদেশিক মুদ্রার আয়ে ভয়াবহ অভিঘাত ফেলতে চলেছে। দক্ষিণ ভারতের তিরুপ্পুর থেকে গুজরাতের সুরাট কিংবা উপকূলবর্তী রাজ্যের মৎস্যশিল্প- সব ক্ষেত্রেই শুরু হয়েছে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ।

Advertisements

মার্কিন প্রশাসনের এই শুল্ক-প্রাচীরের মধ্যেও কিছু খাত আপাতত রেহাই পেয়েছে। তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, ছাড় সাময়িক— পরিস্থিতি বদলাতে সময় লাগবে না।

ওষুধশিল্প

ভারতের জেনেরিক ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলি, যাদের মার্কিন বাজারে রফতানি ১০.৫২ বিলিয়ন ডলার, আপাতত নতুন শুল্কের আওতায় পড়ছে না। যদিও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সতর্ক করেছেন, যেসব বহুজাতিক ওষুধ সংস্থা ভারতের উপর নির্ভরশীল, তাদের ভবিষ্যতে উৎপাদন কার্যক্রম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরিয়ে নিতে চাপ দেওয়া হতে পারে।

ইলেকট্রনিক্স

ভারতে তৈরি হয়ে মার্কিন বাজারে যাওয়া iPhone-এর মতো ডিভাইস এখনই এই শুল্কবৃদ্ধির বাইরে। দ্বিপাক্ষিক চুক্তির আগের ছাড় কার্যকর থাকায় আপাতত স্বস্তি। তবে ট্রাম্প ইতিমধ্যেই অ্যাপল-সহ বহু প্রযুক্তি সংস্থাকে ‘অফশোর প্রোডাকশন’-এর জন্য আক্রমণ করেছেন। FY25-এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের ইলেকট্রনিক্স রফতানি দাঁড়িয়েছে ১৪.৬৪ বিলিয়ন ডলার— যা ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি খাত।

ইস্পাত ও মৌলিক ধাতু

ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের উপর ২৫–৫০ শতাংশ শুল্ক এপ্রিল থেকেই কার্যকর। তবে ভারতীয় এসএমই সংস্থাগুলি প্রধানত লং স্টিল ও রি-রোলড মেটাল রফতানি করে, আর মার্কিন বাজারে চাহিদা বেশি ফ্ল্যাট স্টিল পণ্যে। ফলে এই ধাপে ইস্পাত খাত তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিগ্রস্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের মোট ইস্পাত রফচানির মাত্র ১ শতাংশ ক্রেতা।

পেট্রোলিয়াম ও অন্যান্য পণ্য

FY25-এ ৪.১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পেট্রোলিয়াম রফতানি আপাতত শুল্কমুক্ত থাকছে। একইভাবে ছাড় পাচ্ছে বই, ব্রোশিওর, প্লাস্টিক, সেলুলোজ ইথার, ফেরোম্যাঙ্গানিজ, ফেরোক্রোমিয়াম এবং সার্ভার হার্ডওয়্যার (যেমন মাদারবোর্ড, র্যাক সার্ভার)। অনুমান করা হচ্ছে, প্রায় ২৭.৬ বিলিয়ন ডলারের ভারতীয় রফতানি আপাতত এই নতুন শুল্কের বাইরে।

কেন সংকটের কেন্দ্রে এমএসএমই খাত?

সবচেয়ে বড় আঘাত আসছে ভারতের মাইক্রো, স্মল ও মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ (MSME) খাতে। ক্রিসিলের হিসেবে, টেক্সটাইল, রত্ন ও গয়না, সামুদ্রিক খাদ্য ও কেমিক্যাল— এসব রফতানির ৭০ শতাংশই আসে এমএসএমই থেকে। অথচ এই শিল্পগুলিই এখন সরাসরি মার্কিন শুল্কের নিশানায়।

তিরুপ্পুর (গার্মেন্টস), সুরাট (হিরে), পানিপথ (হোম টেক্সটাইল), মর্ভি (সেরামিক)— এ ধরনের একক খাতভিত্তিক শিল্পকেন্দ্র মূলত কম মুনাফায় চলে, আর দামের সামান্য ওঠানামাতেই বিপর্যয় নেমে আসে। ৫০ শতাংশ শুল্ক কার্যত মার্কিন বাজারে ভারতীয় এমএসএমই-র প্রতিযোগিতামূলক শক্তি কেড়ে নিচ্ছে।

২০১৯ সালে ভারতের জন্য মার্কিন জেনারেলাইজড সিস্টেম অফ প্রেফারেন্সেস (GSP) সুবিধা প্রত্যাহার হওয়ায় রফতানি আগেই ব্যয়বহুল হয়েছিল। এবার শুল্ক দ্বিগুণের ধাক্কায় বহু সংস্থা অর্ডার বাতিল, চালান বন্ধ এবং উৎপাদন হ্রাসের মুখে। ক্রিসিল ইন্টেলিজেন্স-এর ডিরেক্টর পুশন শর্মার সতর্কতা— অতিরিক্ত দামের কিছুটা বোঝা রফতানিকারকরা নিজেরাই বহন করলে তাদের লাভের মার্জিন প্রায় শূন্য হয়ে যাবে, আর এতে ব্যাপক ছাঁটাই ও কর্মসংস্থানের সংকট দেখা দেবে।

Bharat: The US imposes a new 50% tariff on Indian goods, escalating trade tensions. This move, targeting India’s Russian oil trade, severely impacts India’s exports, especially textiles, gems, and seafood. Experts predict a huge blow to India’s economy and export growth.