পহেলগাঁও হামলার প্রত্যাঘাতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের ৫ কঠোর পদক্ষেপ

Pahalgam Terror Attack: জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওে পাকিস্তান-সংযুক্ত জঙ্গিদের হাতে ২৬ জন পর্যটক নিহত হওয়ার পরদিন ভারত সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর ও নজিরবিহীন পদক্ষেপ ঘোষণা…

India Takes 5 Stern Steps Against Pakistan After Pahalgam Terror Attack

Pahalgam Terror Attack: জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওে পাকিস্তান-সংযুক্ত জঙ্গিদের হাতে ২৬ জন পর্যটক নিহত হওয়ার পরদিন ভারত সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর ও নজিরবিহীন পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে। এই হামলা, যা পাকিস্তান-ভিত্তিক লস্কর-ই-তৈবা এবং হিজবুল মুজাহিদিনের সঙ্গে সম্পর্কিত ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ) দ্বারা সংঘটিত বলে জানা গেছে, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (এমইএ) পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে, যা দুই দেশের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের উপর গভীর প্রভাব ফেলবে। এই পদক্ষেপগুলি পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ভারতের কঠোর অবস্থানের ইঙ্গিত দেয়।

১. সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত
ভারত সরকার ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত সিন্ধু জল চুক্তি (ইন্ডাস ওয়াটার্স ট্রিটি) অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রী জানিয়েছেন, “পাকিস্তান সীমান্ত-সংযুক্ত সন্ত্রাসবাদ বন্ধ না করা পর্যন্ত এই চুক্তি স্থগিত থাকবে।” এই চুক্তি সিন্ধু নদী এবং এর উপনদী—ঝিলম, চেনাব, রাভি, বিয়াস এবং সতলুজ—থেকে জল বণ্টন নিয়ন্ত্রণ করে। এই নদীগুলি পাকিস্তানের কৃষি ও জনজীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জল সরবরাহ বন্ধ হলে পাকিস্তানের পাঞ্জাব এবং সিন্ধু প্রদেশের কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং অর্থনীতির উপর মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। এই চুক্তি ১৯৬৫, ১৯৭১ এবং ১৯৯৯ সালের তিনটি যুদ্ধের সময়েও অক্ষত ছিল, তবে এই প্রথম এটি স্থগিত করা হলো।

   

২. পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য সার্ক ভিসা বাতিল
ভারত ঘোষণা করেছে যে, পাকিস্তানি নাগরিকদের আর কোনো সার্ক (দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা) ভিসা দেওয়া হবে না। এই সিদ্ধান্তের ফলে পাকিস্তানি নাগরিকদের ভারতে প্রবেশের সুযোগ উল্লেখযোগ্যভাবে সীমিত হবে। সার্ক ভিসা সাধারণত সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত এবং ব্যবসায়িক কারণে সহজ ভ্রমণের জন্য ব্যবহৃত হয়। এই পদক্ষেপ পাকিস্তানের সঙ্গে সাংস্কৃতিক ও জনগণ-জনগণের যোগাযোগ আরও কমিয়ে দেবে।

৩. অটারি সীমান্ত বন্ধ
ক্যাবিনেট কমিটি অন সিকিউরিটি (সিসিএস) অটারি-ওয়াঘা সীমান্তে অবস্থিত ইন্টিগ্রেটেড চেক পোস্ট (আইসিপি) অবিলম্বে বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সীমান্ত ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্য ও জনগণের চলাচলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ। এটি বন্ধ হওয়ায় দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক এবং সীমান্ত-পারের যোগাযোগ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। এই পদক্ষেপ পাকিস্তানের অর্থনীতির উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করবে, কারণ অটারি সীমান্ত দিয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়।

৪. ভারতীয় হাই কমিশন থেকে কর্মী প্রত্যাহার
ভারত ইসলামাবাদে অবস্থিত ভারতীয় হাই কমিশন থেকে তার কর্মীদের প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই পদক্ষেপ দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে আরও অবনতির ইঙ্গিত দেয়। হাই কমিশনের কর্মী প্রত্যাহারের ফলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক যোগাযোগ কার্যত বন্ধ হয়ে যাবে। এছাড়া, পাকিস্তানের তিনজন কূটনৈতিক কর্মকর্তাকে ভারত ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা কূটনৈতিক সম্পর্কের আরও অবনতির ইঙ্গিত।

৫. পাকিস্তানি নাগরিকদের ভিসা বাতিল ও ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ত্যাগের নির্দেশ
ভারত সরকার পাকিস্তানি নাগরিকদের বর্তমান ভিসা বাতিল করেছে এবং তাদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ভারত ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছে। এই পদক্ষেপের ফলে ভারতে অবস্থানরত পাকিস্তানি নাগরিকদের, যারা ব্যবসা, চিকিৎসা বা অন্যান্য কারণে এসেছেন, তাদের দ্রুত দেশ ছাড়তে হবে। এছাড়া, ভারত পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য ভিসা নিয়ম আরও কঠোর করেছে, যা ভবিষ্যতে তাদের ভারতে প্রবেশকে আরও কঠিন করে তুলবে।

পহেলগাঁও হামলা ও ভারতের কঠোর অবস্থান

২২ এপ্রিল, ২০২৫-এ পহেলগাঁওের বাইসরান মেডোতে সংঘটিত এই জঙ্গি হামলায় ২৬ জন নিহত এবং ২০ জনেরও বেশি আহত হন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের পর্যটক, দুইজন স্থানীয় এবং নেপাল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুই বিদেশি নাগরিক। এই হামলার দায় স্বীকার করেছে টিআরএফ, যারা জম্মু ও কাশ্মীরে ৮৫,০০০-এর বেশি অ-কাশ্মীরি বসতি স্থাপনের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ হিসেবে এই হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করেছে। তদন্তে জানা গেছে, হামলাকারীদের মধ্যে দুজন পাকিস্তানি এবং দুজন স্থানীয় কাশ্মীরি ছিলেন, যারা ২০১৮ সালে পাকিস্তানে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই হামলার তীব্র নিন্দা করে বলেছেন, “এই জঘন্য কাজের পেছনে যারা রয়েছে, তাদের ক্ষমা করা হবে না।” তিনি সৌদি আরব সফর সংক্ষিপ্ত করে দিল্লি ফিরে এসে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেন। সিসিএস-এর বৈঠকে এই পাঁচটি পদক্ষেপ চূড়ান্ত করা হয়।

পাকিস্তানের উপর সম্ভাব্য প্রভাব

এই পদক্ষেপগুলি পাকিস্তানের অর্থনীতি, কৃষি এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের উপর গভীর প্রভাব ফেলবে। সিন্ধু নদী ব্যবস্থা পাকিস্তানের কৃষির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং জল সরবরাহ বন্ধ হলে দেশটির খাদ্য নিরাপত্তা এবং জনজীবন বিপর্যস্ত হতে পারে। অটারি সীমান্ত বন্ধ হওয়ায় বাণিজ্যিক ক্ষতি হবে, এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে আরও বিচ্ছিন্ন করতে পারে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হামলায় নিহতদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বলেছে, “আমরা জম্মু ও কাশ্মীরে পর্যটকদের প্রাণহানির বিষয়ে উদ্বিগ্ন।” তবে, তারা এই অঞ্চলকে “অবৈধভাবে দখলকৃত” বলে উল্লেখ করেছে, যা ভারতের ক্ষোভ আরও বাড়িয়েছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

এই হামলার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইতালি, ইরান, ইসরায়েল, রাশিয়া এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের নেতারা তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রধানমন্ত্রী মোদীকে ফোন করে সমর্থন জানিয়েছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও এই হামলার নিন্দা করেছেন।

পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার পর ভারতের এই পাঁচটি পদক্ষেপ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান প্রকাশ করে। সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত, অটারি সীমান্ত বন্ধ এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার মতো পদক্ষেপগুলি দুই দেশের সম্পর্কে নতুন সংকট সৃষ্টি করতে পারে। তবে, এই পদক্ষেপগুলি ভারতের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহনশীলতা’ নীতির প্রতিফলন। এই পদক্ষেপগুলির দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার উপর এর প্রভাব ভবিষ্যতের ঘটনাপ্রবাহের উপর নির্ভর করবে।

 

Advertisements