জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওে (Kashmir Terror Attack) সাম্প্রতিক ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর ভারত সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর ও শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। এই হামলায় ২৬ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে একজন বিদেশি নাগরিকও রয়েছেন। তদন্তে পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত-সংযুক্ত সন্ত্রাসবাদের যোগসূত্র প্রকাশ পাওয়ায় দেশের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থা, ক্যাবিনেট কমিটি অন সিকিউরিটি (সিসিএস), পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হলো ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত সিন্ধু জল চুক্তি (ইন্ডাস ওয়াটার্স ট্রিটি) অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা। এই সিদ্ধান্তের ফলে সিন্ধু নদী এবং এর উপনদী—ঝিলম, চেনাব, রাভি, বিয়াস এবং সতলুজ—থেকে পাকিস্তানে জল সরবরাহ বন্ধ হবে। এই নদীগুলি পাকিস্তানের জন্য জলের প্রধান উৎস, যা দেশটির কয়েক কোটি মানুষের জীবনযাত্রা ও কৃষির উপর গভীর প্রভাব ফেলে। এই চুক্তি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৬৫, ১৯৭১ এবং ১৯৯৯ সালে তিনটি যুদ্ধের সময়েও অক্ষত ছিল, কিন্তু এখন এটি স্থগিত করা হয়েছে, যা দুই দেশের সম্পর্কে নতুন উত্তেজনার ইঙ্গিত দেয়।
সিন্ধু জল চুক্তি: একটি ঐতিহাসিক চুক্তি
সিন্ধু জল চুক্তি ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছিল, যার মধ্যস্থতা করেছিল বিশ্বব্যাংক। এই চুক্তি সিন্ধু নদী ব্যবস্থার জল বণ্টনের অধিকার ও বাধ্যবাধকতা নির্ধারণ করেছিল। চুক্তি অনুসারে, পূর্বাঞ্চলীয় নদীগুলি—রাভি, বিয়াস এবং সতলুজ—ভারতের নিয়ন্ত্রণে দেওয়া হয়, আর পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীগুলি—সিন্ধু, ঝিলম এবং চেনাব—পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ করা হয়। এই চুক্তি দুই দেশের মধ্যে জল বণ্টনের একটি মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিল, যা দীর্ঘদিন ধরে কার্যকর ছিল।
চুক্তিতে একটি স্থায়ী সিন্ধু কমিশন গঠনের বিধান ছিল, যেখানে দুই দেশের একজন করে কমিশনার থাকেন। এই কমিশন ছোটখাটো বিরোধ নিষ্পত্তি করে এবং বড় বিরোধের জন্য বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ বা আরবিট্রেশন কোর্টের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তান ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরে নির্মিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলির বিরুদ্ধে বারবার আপত্তি তুলেছে, যা চুক্তির প্রতি উত্তেজনা বাড়িয়েছে।
পহেলগাঁও হামলা ও ভারতের প্রতিক্রিয়া
পহেলগাঁওে জঙ্গি হামলা, যেখানে লস্কর-ই-তৈবার সঙ্গে সম্পর্কিত ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ)-এর সঙ্গে যোগসূত্র পাওয়া গেছে, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন সংকট সৃষ্টি করেছে। এই হামলার তদন্তে পাকিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গি নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযোগ প্রকাশ পাওয়ায় ভারত সরকার কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিদেশ সচিব বিক্রম মিশ্রী এক বিবৃতিতে বলেছেন, “এই জঙ্গি হামলার গুরুত্ব বিবেচনা করে, সিসিএস সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, পাকিস্তান সীমান্ত-সংযুক্ত সন্ত্রাসবাদের সমর্থন থেকে পুরোপুরি সরে না আসা পর্যন্ত ১৯৬০ সালের সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত থাকবে।”
চুক্তি স্থগিত করার পাশাপাশি, ভারত পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য সব ভিসা ছাড় বাতিল করেছে এবং আটারি-ওয়াঘা সীমান্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই পদক্ষেপগুলি ভারতের পাকিস্তানের প্রতি কঠোর কূটনৈতিক অবস্থানের ইঙ্গিত দেয়।
পাকিস্তানের উপর প্রভাব
সিন্ধু নদী ব্যবস্থা পাকিস্তানের কৃষি ও অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানের পাঞ্জাব এবং সিন্ধু প্রদেশের কৃষি এই নদীগুলির জলের উপর নির্ভরশীল। চুক্তি অনুসারে, পাকিস্তান সিন্ধু নদী ব্যবস্থার প্রায় ৮০% জল পায়, যা দেশটির খাদ্য উৎপাদন এবং জনসংখ্যার জীবিকার জন্য অপরিহার্য। জল সরবরাহ বন্ধ হলে পাকিস্তানের কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং অর্থনীতির উপর মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে।
পাকিস্তানের কৃষি খাত, বিশেষ করে পাঞ্জাব প্রদেশ, সিন্ধু, ঝিলম এবং চেনাব নদীর জলের উপর নির্ভর করে। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯০% খাদ্য এবং ৬৫% কর্মসংস্থান কৃষি ও পশুপালনের উপর নির্ভরশীল, যা সিন্ধু নদী ব্যবস্থা দ্বারা টিকিয়ে রাখা হয়। জল সরবরাহ বন্ধ হলে দেশটির অর্থনীতি এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার উপর গভীর প্রভাব পড়তে পারে।
ভারতের কৌশলগত পদক্ষেপ
ভারতের এই সিদ্ধান্ত কেবল সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নয়, বরং পাকিস্তানের উপর অর্থনৈতিক ও কৌশলগত চাপ সৃষ্টির একটি প্রয়াস। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০১৬ সালের উরি হামলার পর বলেছিলেন, “রক্ত ও জল একসঙ্গে বইতে পারে না।” এই ঘোষণার পর ভারত পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীগুলির জল ব্যবহারের সম্ভাবনা বাড়ানোর জন্য কয়েকটি প্রকল্প দ্রুততর করেছিল, যেমন শাহপুরকান্দি বাঁধ প্রকল্প, উজে বাঁধ প্রকল্প এবং রাভি-বিয়াস লিঙ্ক।
বিশ্লেষকদের মতে, এই সিদ্ধান্ত ভারতের কৌশলগত অবস্থানকে শক্তিশালী করবে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের প্রেক্ষিতে। হামলার সময় মার্কিন উপ-রাষ্ট্রপতি জেডি ভ্যান্স ভারতে সফরে ছিলেন, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ভারতের পক্ষে সমর্থন তৈরি করতে সহায়ক হতে পারে।
আন্তর্জাতিক প্রভাব
সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক মঞ্চে বিতর্কের জন্ম দিতে পারে। বিশ্বব্যাংক, যিনি এই চুক্তির মধ্যস্থতাকারী, এই বিষয়ে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ এড়াতে চাইবে। তবে, ভারতের এই পদক্ষেপ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলির, যেমন বাংলাদেশ, নেপাল এবং চীনের, জল-ভাগাভাগি চুক্তির বিষয়ে নজর রাখতে পারে।
কিছু বিশ্লেষক সতর্ক করেছেন যে, চুক্তি স্থগিত করা পাকিস্তানের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। ২০১৬ সালে পাকিস্তানের একজন নেতা বলেছিলেন, চুক্তির একতরফা বাতিলকে “যুদ্ধের কাজ” হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। এছাড়া, চীন, যিনি পাকিস্তানের সমর্থক, সিন্ধু বা ব্রহ্মপুত্র নদীর জল প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
পহেলগাঁওে জঙ্গি হামলার পর ভারতের সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত দুই দেশের সম্পর্কে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এই পদক্ষেপ পাকিস্তানের অর্থনীতি ও জনজীবনের উপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে, তবে এটি আঞ্চলিক উত্তেজনাও বাড়াতে পারে। ভারতের এই কৌশলগত সিদ্ধান্ত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান প্রদর্শন করলেও, এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ভবিষ্যতের ঘটনাপ্রবাহের উপর নির্ভর করবে।