জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার (Pahalgam Attack) পর ভারত তার সামরিক শক্তি এবং প্রস্তুতির একটি শক্তিশালী প্রদর্শনের মাধ্যমে জবাব দিয়েছে। এই প্রতিক্রিয়া শুধু তাৎক্ষণিক প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি বহুমুখী কৌশলের অংশ, যার মধ্যে রয়েছে উল্লেখযোগ্য সামরিক মহড়া, নতুন প্রতিরক্ষা ক্ষমতার প্রদর্শন এবং চলমান কূটনৈতিক প্রচেষ্টা। এই ঘটনা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি অঙ্গীকার এবং সম্ভাব্য প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের একটি স্পষ্ট বার্তা।
ভারতীয় বিমান বাহিনীর শক্তি প্রদর্শন
ভারতীয় বিমান বাহিনী (আইএএফ) এই সামরিক প্রতিক্রিয়ার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। রাফাল এবং এসইউ-৩০ যুদ্ধবিমান নিয়ে রাত্রিকালীন উড়ান পরিচালিত হয়েছে, যা এলাকা নিয়ন্ত্রণ অভিযানের অংশ। প্রকাশিত ছবিগুলোতে দেখা যাচ্ছে, এই বিমানগুলো মহড়ায় অংশ নিচ্ছে, যা আইএএফ-এর যেকোনো হুমকির জবাব দেওয়ার প্রস্তুতির স্পষ্ট ইঙ্গিত। যদিও আইএএফ এই মহড়াগুলোকে নিয়মিত বলে বর্ণনা করতে পারে, তবে এর সময় এবং তাৎপর্য অস্বীকার করা যায় না। এই মহড়াগুলোর কিছু অংশ উড়ি-র কাছাকাছি এলাকায় পরিচালিত হয়েছে, যেখানে অতীতে জঙ্গি হামলা হয়েছিল। এটি এই সামরিক প্রদর্শনের প্রতীকী গুরুত্বকে আরও জোরালো করে। রাফাল যুদ্ধবিমানগুলো, যা দীর্ঘ-পরিসরের স্কাল্প মিসাইল দিয়ে সজ্জিত, ভারতের বিমান বাহিনীর আধুনিকীকরণ এবং শক্তিশালী ক্ষমতার প্রমাণ। এই মহড়ায় এসইউ-৩০ এমকেআই এবং এস-৪০০ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও অংশ নিয়েছে, যা ভারতের বহুমুখী প্রতিরক্ষা কৌশলকে তুলে ধরে।
ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব
একই সঙ্গে, ভারতীয় নৌবাহিনী তার উন্নত প্রযুক্তিগত ক্ষমতার প্রদর্শন করেছে। দেশীয় প্রযুক্তিতে নির্মিত গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার আইএনএস সুরাত একটি নিম্ন-উড়ন্ত, রাডার-এড়ানো লক্ষ্যবস্তুর উপর সফলভাবে নির্ভুল আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছে। এই সাফল্য শুধু ভারতের নৌবাহিনীর প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বই প্রমাণ করে না, বরং নেটওয়ার্কযুক্ত যুদ্ধ পরিবেশে সমন্বিত অভিযান পরিচালনার ক্ষমতাও তুলে ধরে। আইএনএস সুরাত থেকে ৭০ কিলোমিটার পরিসরের মাঝারি দূরত্বের সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল (এমআরএসএএম) পরীক্ষামূলকভাবে নিক্ষেপ করা হয়েছে, যা দেশীয় প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির কার্যকারিতা এবং নির্ভরযোগ্যতার প্রমাণ। এই পরীক্ষা আরব সাগরে পরিচালিত হয়েছে, যা ভারতের নৌশক্তির কৌশলগত গুরুত্বকে আরও উজ্জ্বল করে।
সমন্বিত সামরিক কৌশল
ভারতীয় বিমান বাহিনী এবং নৌবাহিনীর এই সম্মিলিত সামরিক পদক্ষেপ, স্থল বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে, জাতীয় নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য একটি সমন্বিত, বহু-স্তরীয় কৌশলের ইঙ্গিত দেয়। সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী পহেলগাঁও হামলার পর স্থল পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে শ্রীনগরে পৌঁছেছেন এবং হামলার স্থান পরিদর্শন করেছেন। এই পদক্ষেপগুলো ভারতের সামরিক বাহিনীর তিনটি শাখা—স্থল, নৌ এবং বিমান বাহিনী—এর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ের প্রমাণ। সীমান্ত এলাকায় রাফাল জেটের টহলদারি, জঙ্গি আস্তানা ধ্বংস এবং নিরাপত্তা বাহিনীর তীব্র তৎপরতা পহেলগাঁও হামলার পর ভারতের কঠোর অবস্থানকে স্পষ্ট করে।
আন্তর্জাতিক বার্তা এবং কূটনৈতিক পদক্ষেপ
এই সামরিক প্রদর্শন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে একটি শক্তিশালী বার্তা। পহেলগাঁও হামলার জন্য পাকিস্তান-সমর্থিত জঙ্গি গোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বাকে দায়ী করা হয়েছে, এবং ভারত এই হামলার পেছনের মূল পরিকল্পনাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের অঙ্গীকার করেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী স্পষ্টভাবে বলেছেন যে জঙ্গিদের এবং তাদের সমর্থনকারীদের শাস্তি দেওয়া হবে। এই প্রেক্ষাপটে, ভারত ইন্দাস জল চুক্তি স্থগিত করেছে, যা পাকিস্তানের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক পদক্ষেপ। পাকিস্তান এই পদক্ষেপকে ‘যুদ্ধের কাজ’ হিসেবে বর্ণনা করেছে এবং প্রতিক্রিয়ায় শিমলা চুক্তি স্থগিত করেছে। এই কূটনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে ভারতের সামরিক মহড়া তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষার ক্ষমতা এবং সংকল্পের প্রতীক।
জনমত এবং সামাজিক প্রতিক্রিয়া
পহেলগাঁও হামলায় ২৬ জন নিরীহ পর্যটকের মৃত্যুতে দেশজুড়ে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। দিল্লি, সুরাট এবং অন্যান্য শহরে বিক্ষোভ এবং মোমবাতি মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে ভারতের সামরিক প্রস্তুতির প্রশংসা করা হচ্ছে, এবং অনেকে এই হামলার জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন।
পহেলগাঁও হামলার পর ভারতের সামরিক এবং কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া তার জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি অটুট প্রতিশ্রুতি এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার নীতিকে তুলে ধরে। ভারতীয় বিমান বাহিনী এবং নৌবাহিনীর সমন্বিত মহড়া, আইএনএস সুরাতের সফল মিসাইল পরীক্ষা এবং রাফাল জেটের শক্তি প্রদর্শন ভারতের প্রতিরক্ষা ক্ষমতার আধুনিকীকরণ এবং কৌশলগত প্রস্তুতির প্রমাণ। এই পদক্ষেপগুলো শুধু জঙ্গি হুমকির জবাব নয়, বরং ভারতের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষার প্রতিশ্রুতির একটি স্পষ্ট ঘোষণা।