নয়াদিল্লি: ২০০১ সালের সংসদ হামলার পর ভারত ও পাকিস্তান কার্যত যুদ্ধের প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল— এমনই চাঞ্চল্যকর মন্তব্য করলেন মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (সিআইএ)-র প্রাক্তন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জন কিরিয়াকু। একান্ত সাক্ষাৎকারে ANI-কে দেওয়া তাঁর বক্তব্যে উঠে এসেছে দক্ষিণ এশিয়ার উত্তপ্ত ভূরাজনীতির অন্তরালের এক অজানা অধ্যায়।
অপারেশন পরাক্রম
কিরিয়াকু জানান, ২০০২ সালের অপারেশন পরাক্রম-এর সময় আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থাগুলি নিশ্চিত ছিল যে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ শুরু হতে চলেছে। “আমরা বিশ্বাস করেছিলাম, যুদ্ধ আসন্ন। ইসলামাবাদ থেকে আমেরিকান কূটনীতিকদের পরিবারদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। মার্কিন উপ-বিদেশমন্ত্রী তখন দিল্লি ও ইসলামাবাদে বারবার যাতায়াত করে দুই পক্ষকে পিছু হটতে রাজি করান,” দাবি তাঁর
তবে স্বীকারোক্তি এসেছে আরেকটি তিক্ত বাস্তবের— “আমরা তখন এতটাই ব্যস্ত ছিলাম আল-কায়েদা আর আফগানিস্তান নিয়ে, যে ভারতের দিকে দ্বিতীয়বার তাকানোরও সুযোগ হয়নি।”
‘ভারতে সন্ত্রাস চালাচ্ছিল পাকিস্তান, অথচ বিশ্ব নীরব ছিল’ India Pakistan Near War CIA
পরবর্তী সময়ে, বিশেষ করে ২০০৮ সালের মুম্বই হামলার প্রসঙ্গে কিরিয়াকু স্পষ্ট মন্তব্য করেন— “আমি কখনও বিশ্বাস করিনি এটা আল-কায়েদার কাজ। এটা ছিল পাকিস্তান-সমর্থিত কাশ্মীরি সংগঠনগুলির কাজ, এবং পরে সেটাই প্রমাণিত হয়।”
তিনি যোগ করেন, “পাকিস্তান ভারতে সন্ত্রাস চালাচ্ছিল, অথচ কেউ কিছু করছিল না। সেটাই ছিল সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা— বিশ্বের নীরবতা।”
‘ভারতের ধৈর্য কৌশল নয়, শক্তির প্রকাশ’
কিরিয়াকু জানান, সিআইএ-র অভ্যন্তরে একসময় ভারতের অবস্থানকে বলা হত ‘স্ট্র্যাটেজিক পেশেন্স’— অর্থাৎ কৌশলগত ধৈর্য। তিনি বলেন, “সংসদ হামলা থেকে মুম্বই পর্যন্ত ভারত সংযম দেখিয়েছে৷ কিন্তু এখন ভারত এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে, যেখানে এই ধৈর্যকে দুর্বলতা বলে ভুল করলে তার ফল ভয়ঙ্কর হবে।”
তাঁর মতে, “ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যদি যুদ্ধ বাধে, পাকিস্তান নিশ্চিতভাবে হারবে— আমি পারমাণবিক নয়, প্রচলিত যুদ্ধের কথাই বলছি। ভারতের সামরিক ভারসাম্য এতটাই প্রবল যে পাকিস্তানের উস্কানিতে কোনও লাভ নেই।”
তিনি উদাহরণ দেন, “২০১৬-র সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, ২০১৯-র বালাকোট এয়ারস্ট্রাইক থেকে শুরু করে এ বছরের পাহালগাঁও হামলার পর ‘অপারেশন সিন্দূর’— ভারত বারবার প্রমাণ করেছে, সন্ত্রাস বা পারমাণবিক হুমকি দিয়ে আর তাকে থামানো যাবে না।”
‘দুটি আইএসআই- এক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, আরেক সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষক’
পাকিস্তানে নিজের দায়িত্বকাল স্মরণ করে কিরিয়াকু বলেন, দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই কার্যত দুই মুখে বিভক্ত। তাঁর কথায়, “একটি অংশ স্যান্ডহার্স্ট ও এফবিআই দ্বারা প্রশিক্ষিত পেশাদার অফিসারদের নিয়ে, আরেকটি অংশে ছিল দাড়িওয়ালা উগ্রবাদীরা- যারা জইশ-ই-মহম্মদের মতো সংগঠন গড়ে তুলেছিল৷”
২০০২ সালের এক অভিযানের প্রসঙ্গ টেনে তিনি জানান, “লাহৌরে লস্কর-ই-তইয়বার তিন জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাঁদের কাছ থেকে আল-কায়েদার প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল উদ্ধার হয়। সেখান থেকেই প্রথমবার পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আল-কায়েদার সরাসরি যোগের প্রমাণ মেলে।”
তবু কেন ওয়াশিংটন সেই সময় কোনও পদক্ষেপ নিল না? তাঁর জবাব, “সেটা ছিল হোয়াইট হাউসের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তখন সম্পর্কের অগ্রাধিকার ছিল, আমরা পাকিস্তানকে যতটা প্রয়োজন ছিল, পাকিস্তান আমাদের তার চেয়ে কম প্রয়োজন ছিল।”
কে এই জন কিরিয়াকু?
জন কিরিয়াকু প্রায় ১৫ বছর কাজ করেছেন সিআইএ-তে প্রথমে বিশ্লেষক, পরে ৯/১১-র পর পাকিস্তানে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নেতৃত্বে। পেশোয়ার, করাচি, লাহৌর, কোয়েটা থেকে আল-কায়েদা জঙ্গিদের গতিবিধি ট্র্যাক করেছিলেন তিনি। পরে সিআইএ-র ডেপুটি ডিরেক্টর (অপারেশনস)-এর এক্সিকিউটিভ অ্যাসিস্ট্যান্ট হন।
২০০৭ সালে তিনি প্রথম প্রকাশ্যে জানান, সিআইএ বন্দিদের জিজ্ঞাসাবাদে ওয়াটারবোর্ডিং ব্যবহার করেছে, যা মার্কিন ইতিহাসে নির্যাতনের প্রতীক হয়ে ওঠে। এর পর তাঁকে ২৩ মাসের কারাদণ্ড হয়। আজও তিনি বলেন, “আমার কোনও অনুশোচনা নেই, কোনও অনুতাপ নেই।”


