নয়াদিল্লি: অবশেষে ভারতের খাদ্য সুরক্ষা সংস্থা ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস অথরিটি অব ইন্ডিয়া (FSSAI) এমন এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা শিশুস্বাস্থ্যের ইতিহাসে মাইলফলক হতে পারে। এখন থেকে কোনও পানীয় যদি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত Oral Rehydration Solution (ORS)-এর বৈজ্ঞানিক উপাদানসমূহ না মেনে তৈরি হয়, তবে সেই পানীয় আর “ORS” নামে বাজারজাত করা যাবে না।
এই নির্দেশ এসেছে হায়দরাবাদের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শিবরঞ্জিনী সান্থোষ-এর দীর্ঘ আট বছরের সংগ্রামের ফলস্বরূপ। তিনি লক্ষ করেছিলেন, ডায়রিয়া আক্রান্ত অনেক শিশু এমন “ORS” পানীয় পান করছে যা আসলে চিকিৎসাগতভাবে সম্পূর্ণ ভুয়ো। এর ফলে জলশূন্যতা আরও বেড়ে গিয়ে প্রাণহানির আশঙ্কা তৈরি হচ্ছিল।
ডা. সান্থোষ বলেন, “মানুষ বোতলে ‘ORS’ লেখা দেখেই ধরে নিচ্ছিল এটি ওষুধের সমাধান। কিন্তু আসলে এগুলি অতিরিক্ত চিনি আর কম লবণযুক্ত পানীয়, যা ডায়রিয়াকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল।”
প্রকৃত ওআরএস, যা WHO অনুমোদিত, তাতে গ্লুকোজ, সোডিয়াম ক্লোরাইড ও পটাসিয়াম ক্লোরাইডের নির্দিষ্ট অনুপাত থাকে। এই সঠিক মিশ্রণ শরীরে জলের ভারসাম্য পুনরুদ্ধারে সহায়ক। অথচ বাজারে বিক্রি হওয়া তথাকথিত ‘রিহাইড্রেশন’ বা ‘রিপেয়ার ড্রিংক’-এ চিনি মাত্রা এত বেশি যে তা শরীরের জলের ঘাটতি পূরণ না করে উল্টে অন্ত্রে জল টেনে নিয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিরিক্ত চিনি ডায়রিয়াকে আরও গুরুতর করে তোলে। এর ফলে অনেক শিশুর জীবন ঝুঁকিতে পড়ছে। ডা. সান্থোষ বলেন, “ওআরএস মানে জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসা। সেটিকেই ব্যবসায়িক প্রতারণা দিয়ে বিকৃত করা হচ্ছিল।”
২০১৭ সাল থেকে তিনি এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ শুরু করেন, বিভিন্ন হাসপাতালের কেস রিপোর্ট বিশ্লেষণ করেন এবং পরে বড় বড় সংস্থা যেমন জনসন অ্যান্ড জনসন ও ড. রেড্ডিজ ল্যাবস-এর মতো কোম্পানির পণ্যের রাসায়নিক গঠন পরীক্ষা করান। তিনি একাধিকবার কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও রাজ্য প্রশাসনের দ্বারস্থ হন।
লড়াইটা সহজ ছিল না। তিনি বলেন, “আমাকে অনেকেই উপহাস করেছে। কেউ কেউ বলেছে বড় কোম্পানির বিরুদ্ধে কেন যাচ্ছি। কিন্তু প্রতিটি শিশুর জীবন আমার কাছে মূল্যবান।”
অবশেষে ২০২৫ সালের অক্টোবরে এফএসএসএআই এক ঐতিহাসিক নির্দেশ জারি করে জানায়, “ORS” শব্দটি শুধুমাত্র সেসব পণ্যই ব্যবহার করতে পারবে, যেগুলি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী তৈরি। এমনকি ‘Not a medical ORS’ লেখা থাকলেও, কোনও বাণিজ্যিক পানীয়ের নাম বা লোগোতে এই শব্দ ব্যবহার করা আইনবিরুদ্ধ।
এই পদক্ষেপে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মধ্যে স্বস্তি দেখা দিয়েছে। কারণ, ভারতে এখনও পাঁচ বছরের নিচে শিশুদের মৃত্যুর প্রায় ১৩ শতাংশের কারণ ডায়রিয়া। সঠিক ওআরএস ব্যবহার এই মৃত্যুহার অনেকাংশে কমাতে পারে।
ডা. সান্থোষ বলেন, “এটা শুধু আমার ব্যক্তিগত লড়াই নয়, এটা কোটি শিশুর জীবনের লড়াই। আজ অন্তত একটা বার্তা গেছে বাণিজ্যিক মুনাফা শিশুর জীবনের চেয়ে বড় নয়।”
এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এফএসএসএআই শুধু একধরনের প্রতারণার ইতি টানল না, বরং জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষায় নৈতিক দায়িত্বও স্মরণ করিয়ে দিল। আগামী দিনে এই নির্দেশ বাস্তবায়নে কড়া নজরদারি চলবে বলে সংস্থা সূত্রে জানা গেছে।