‘ড্রাই রাজ্য’ গুজরাটে দুই বছরে মদ বেচে ৩৩.৯৮ কোটি টাকা কর আদায়

গুজরাট, যে রাজ্যটি মহাত্মা গান্ধীর জন্মভূমি (Gujarat) হিসেবে পরিচিত এবং যেখানে মদ্যপান ও মদ বিক্রির উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, সেখানে গত দুই বছরে ২৮টি হোটেলের…

Gujarat Liquor Tax Revenue

গুজরাট, যে রাজ্যটি মহাত্মা গান্ধীর জন্মভূমি (Gujarat) হিসেবে পরিচিত এবং যেখানে মদ্যপান ও মদ বিক্রির উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, সেখানে গত দুই বছরে ২৮টি হোটেলের মাধ্যমে মদ বিক্রি থেকে রাজ্য সরকার ৩৩.৯৮ কোটি টাকা কর আদায় করেছে। এই তথ্য সোমবার গুজরাট বিধানসভায় চলমান বাজেট অধিবেশনের সময় প্রকাশিত হয়েছে।

বিধানসভার প্রশ্নোত্তর পর্বে কংগ্রেস বিধায়ক ইমরান খেদাওয়ালা এই বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তিনি জানতে চেয়েছিলেন, আহমেদাবাদ এবং গান্ধীনগর জেলায় কতগুলি হোটেলকে মদ বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয়েছে এবং গত দুই বছরে এই বিক্রি থেকে সরকার কত টাকা কর আদায় করেছে। এর জবাবে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র প্যাটেল, যিনি নিষেধাজ্ঞা ও আবগারি বিভাগের দায়িত্বে রয়েছেন, লিখিতভাবে জানিয়েছেন যে আহমেদাবাদ জেলায় ২২টি এবং গান্ধীনগর জেলায় ৬টি হোটেলকে মদ বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এই হোটেলগুলির মাধ্যমে মদ বিক্রি থেকে আদায় করা করের পরিমাণই ৩৩.৯৮ কোটি টাকা।

   

‘ড্রাই রাজ্য’ গুজরাটে মদ বিক্রির বৈপরীত্য
গুজরাট ভারতের একটি ‘শুষ্ক’ রাজ্য হিসেবে পরিচিত, যেখানে ১৯৬০ সালে রাজ্য গঠনের পর থেকেই মদ্যপান এবং মদ বিক্রির উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে। বোম্বে প্রোহিবিশন অ্যাক্ট, ১৯৪৯ অনুযায়ী, গুজরাটে মদ কেনা, রাখা, পান করা বা পরিবেশন করতে হলে অনুমতিপত্র বা পারমিট প্রয়োজন। এই আইনের অধীনে পারমিট ছাড়া মদ কেনা বা পান করলে তিন মাস থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত জেল এবং মদ পরিবহনের জন্য ৫০,০০০ টাকা জরিমানা ও পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। তবে, এই কঠোর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও নির্দিষ্ট হোটেলগুলিতে মদ বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যা রাজ্যের জন্য উল্লেখযোগ্য রাজস্ব এনে দিচ্ছে।

মুখ্যমন্ত্রী প্যাটেল জানিয়েছেন, গত দুই বছরে এই হোটেলগুলি থেকে মদ বিক্রির কর হিসেবে ২০২৩ সালে (ফেব্রুয়ারি ২০২৩ থেকে জানুয়ারি ২০২৪) ১৪.৪৫ কোটি টাকা এবং ২০২৪ সালে (ফেব্রুয়ারি ২০২৪ থেকে জানুয়ারি ২০২৫) ১৯.৫৩ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। এই পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, মদ বিক্রি থেকে আয় গত দুই বছরে ৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই তথ্য গুজরাটের ‘শুষ্ক’ নীতির সঙ্গে বাস্তবতার একটি বৈপরীত্য তুলে ধরেছে।

কীভাবে সম্ভব হল এই বিক্রি?
গুজরাটে মদ বিক্রি ও পানের উপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও, কিছু ব্যতিক্রমী নিয়ম রয়েছে। পর্যটকদের জন্য এবং নির্দিষ্ট স্বাস্থ্য কারণে পারমিটধারীদের জন্য মদ কেনার অনুমতি দেওয়া হয়। এছাড়া, গুজরাট ইন্টারন্যাশনাল ফিনান্স টেক-সিটি (গিফট সিটি)-তে ২০২৩ সালে মদ্যপানের নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হয়েছে। এই হোটেলগুলি সাধারণত উচ্চমানের এবং পর্যটকদের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়, যেখানে পারমিটধারী ব্যক্তিরা মদ কিনতে ও পান করতে পারেন। আহমেদাবাদ এবং গান্ধীনগরের এই ২৮টি হোটেলও এই বিশেষ অনুমতির আওতায় এসেছে।

গান্ধীনগরের গিফট সিটি, যা একটি আন্তর্জাতিক আর্থিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠছে, সেখানে “ওয়াইন অ্যান্ড ডাইন” সুবিধা চালু করা হয়েছে। এই এলাকায় কর্মরত কর্মচারী, কোম্পানির মালিক এবং অনুমোদিত দর্শনার্থীদের জন্য মদ পানের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এই শিথিলতার পিছনে উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বব্যাপী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে আকর্ষণ করা এবং এই অঞ্চলকে সিঙ্গাপুরের মতো আর্থিক কেন্দ্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নিয়ে আসা। এই হোটেলগুলির মাধ্যমে মদ বিক্রি এই নীতিরই একটি অংশ।

রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া
ইমরান খেদাওয়ালার প্রশ্নের মাধ্যমে এই বিষয়টি বিধানসভায় উঠে আসায় রাজনৈতিক বিতর্কের সূচনা হয়েছে। কংগ্রেস এই তথ্যকে হাতিয়ার করে বিজেপি সরকারের নীতির সমালোচনা করতে পারে। বিরোধী দলগুলি দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে যে গুজরাটে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও অবৈধ মদ বিক্রি এবং পারমিটের অপব্যবহার চলছে। এই ৩৩.৯৮ কোটি টাকার কর আদায়ের তথ্য তাদের এই যুক্তিকে আরও জোরালো করতে পারে।

সামাজিক মাধ্যমে এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর জনগণের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন, “গুজরাট শুষ্ক রাজ্য হয়েও এত টাকা মদ থেকে আয় করছে, এটা কি গান্ধীজির আদর্শের সঙ্গে মেলে?” আরেকজন লিখেছেন, “এই টাকা রাজ্যের উন্নয়নে ব্যবহার হলে সমস্যা কী?” এই বিতর্ক গুজরাটের নিষেধাজ্ঞা নীতির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

Advertisements

অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ
এই কর আদায় গুজরাটের অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। ৩৫ শতাংশ আয় বৃদ্ধি দেখায় যে এই হোটেলগুলির মাধ্যমে মদ বিক্রি ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পর্যটক এবং ব্যবসায়ীদের জন্য এই সুবিধা রাজ্যের পর্যটন ও বাণিজ্য খাতকে উৎসাহিত করছে। তবে, এটি নিষেধাজ্ঞার নৈতিক দিক নিয়ে প্রশ্নও তুলছে।

গুজরাটে পারমিটধারীদের সংখ্যাও বাড়ছে। ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, রাজ্যে ৪৩,৪৭০ জনের মদ পানের পারমিট রয়েছে, যা ২০২০ সালের তুলনায় ৫৮ শতাংশ বেশি। আহমেদাবাদে সর্বাধিক ১৩,৪৫৬টি পারমিট রয়েছে। এই হোটেলগুলি এই পারমিটধারীদের জন্যই মদ বিক্রি করছে, যা রাজস্ব বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।

সমালোচনা ও ভবিষ্যৎ
কিছু সমালোচক মনে করেন, এই নীতি গুজরাটের ‘শুষ্ক’ পরিচয়কে দুর্বল করছে। তারা বলছেন, যদি সরকার মদ বিক্রি থেকে এত রাজস্ব আদায় করতে পারে, তাহলে নিষেধাজ্ঞার প্রকৃত অর্থ কী? অন্যদিকে, সমর্থকরা বলছেন, এই আয় রাজ্যের উন্নয়নে কাজে লাগছে এবং এটি পর্যটকদের জন্য একটি বাস্তবসম্মত সমাধান।

গিফট সিটিতে মদ্যপানের শিথিলতার পর এই হোটেলগুলির মাধ্যমে বিক্রি আরও বাড়তে পারে। তবে, এই আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সরকারকে নিষেধাজ্ঞার কঠোরতা এবং সামাজিক প্রভাবের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।

গুজরাটে মদ বিক্রি থেকে ৩৩.৯৮ কোটি টাকা কর আদায়ের তথ্য একদিকে রাজ্যের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে তুলে ধরেছে, অন্যদিকে এর নিষেধাজ্ঞা নীতির বৈপরীত্যকে প্রকাশ করেছে। আহমেদাবাদ ও গান্ধীনগরের ২৮টি হোটেলের এই অবদান রাজ্যের পর্যটন ও বাণিজ্য খাতে নতুন দিগন্ত খুলছে। তবে, এই পদক্ষেপ কীভাবে গুজরাটের সামাজিক ও নৈতিক পরিচয়কে প্রভাবিত করে, তা নিয়ে আলোচনা ভবিষ্যতে আরও জোরদার হতে পারে। এই ঘটনা গুজরাটের ‘শুষ্ক’ রাজ্যের ইমেজ এবং বাস্তবতার মধ্যে একটি জটিল সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়।