ভারতের আবহাওয়া বিভাগ (IMD) সতর্ক করে জানিয়েছে যে, ২০২৫ সালের গ্রীষ্মে উত্তর-পশ্চিম ভারতে তাপপ্রবাহের দিনের সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হতে পারে। সাধারণত এই অঞ্চলে একটি মরশুমে ৫ থেকে ৬টি তাপপ্রবাহের দিন দেখা যায়, কিন্তু এই বছর ১০ থেকে ১২টি দিন পর্যন্ত তাপপ্রবাহ হতে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
আইএমডি-র বিজ্ঞানী সোমা সেন রায় বলেন, “আমরা এই গ্রীষ্মে পশ্চিম ও মধ্য ভারতে স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি তাপপ্রবাহের পরিস্থিতি আশা করছি। উত্তর-পশ্চিম ভারতে সাধারণত ৫ থেকে ৬টি তাপপ্রবাহের দিন থাকে। এই বছর আমরা ১০ থেকে ১২টি দিন আশা করছি, যা স্বাভাবিকের দ্বিগুণ।” তবে তিনি স্পষ্ট করেছেন যে, এটি একটি মৌসুমি পূর্বাভাস এবং এর মানে এই নয় যে পুরো মরশুম জুড়ে প্রতিদিনই স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি গরম থাকবে। তিনি আরও জানান, আইএমডি দীর্ঘমেয়াদি এবং দৈনিক পূর্বাভাসের মাধ্যমে স্থানীয় স্তরে আরও সঠিক তথ্য প্রদানের জন্য পূর্বাভাস আপডেট করতে থাকবে।
২০২৪-এর তুলনায় ২০২৫ কি বেশি গরম হবে?
আইএমডি-র এই কর্মকর্তা ২০২৫ সালের গ্রীষ্ম ২০২৪-এর তুলনায় বেশি গরম হবে কিনা, সে বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেননি। উল্লেখ্য, ২০২৪ সাল ছিল ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণতম বছর, যখন দেশে মোট ৫৫৪টি তাপপ্রবাহের দিন রেকর্ড করা হয়েছিল। আবহাওয়া বিভাগের সংজ্ঞা অনুযায়ী, সমতল ভূমিতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা কমপক্ষে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছলে বা স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ ডিগ্রি বেশি হলে তাকে তাপপ্রবাহ বলা হয়।
মার্চ থেকে মে: তাপমাত্রার পূর্বাভাস
আইএমডি-র সর্বশেষ মৌসুমি তাপ আউটলুক, যা ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এ প্রকাশিত হয়েছে, সতর্ক করে জানিয়েছে যে মার্চ থেকে মে পর্যন্ত দেশের বেশিরভাগ অংশে সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকবে। তবে, উপদ্বীপীয় ভারতের দক্ষিণতম অঞ্চল এবং উত্তর-পূর্বের কিছু বিচ্ছিন্ন এলাকায় তাপমাত্রা স্বাভাবিক বা সামান্য কম থাকতে পারে। পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, “মার্চ থেকে মে (এমএএম) মরশুমে, উপদ্বীপীয় ভারতের দক্ষিণতম কিছু বিচ্ছিন্ন অঞ্চল ছাড়া দেশের বেশিরভাগ অংশে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকবে।”
আগামী দিনে উত্তর ভারতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি
আগামী কয়েক দিনে উত্তর ভারতে তাপমাত্রা আরও বাড়বে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। দিল্লি এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় তাপমাত্রা ১-২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে। তবে, উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আসা ধুলোবালি মিশ্রিত বাতাসের কারণে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩-৪ ডিগ্রি কমে যাবে। এই বাতাস, যা ঘণ্টায় ২০-৩০ কিলোমিটার বেগে প্রবাহিত হবে, আগামী তিন দিন ধরে পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং রাজস্থানে আবহাওয়াকে ধুলোময় ও শুষ্ক করে তুলবে।
দিল্লির মানুষের উদ্বেগ
ইন্ডিয়া গেটে, যেখানে পরিবার এবং পর্যটকরা ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা সত্ত্বেও সমবেত হয়েছিলেন, অনেকেই গরম নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। দিল্লির বাসিন্দা অনিল শর্মা, যিনি তার পরিবারের সঙ্গে ঘুরতে এসেছিলেন, বলেন, “এখন থেকেই গরম এত বেশি, মে-জুন মাসে তো অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে।” ছেলের হাত ধরে তিনি আরও যোগ করেন, “গত বছরও গরম ছিল, কিন্তু এই বছর বেশি মনে হচ্ছে।” কাছেই পিকনিকে আসা কলেজ ছাত্রী ঋতিকা জৈনও একই হতাশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “প্রতিদিন রোদ থেকে বাঁচার চেষ্টা করি, কিন্তু গরম থেকে কোনও রেহাই নেই। ছায়ার নীচে বসলেও আরাম লাগছে না।”
বাংলার প্রেক্ষাপটে তাপপ্রবাহের প্রভাব
পশ্চিমবঙ্গে গ্রীষ্মকালে তাপপ্রবাহের প্রভাব সাধারণত তীব্র হয়, বিশেষ করে দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলোতে। যদিও এই পূর্বাভাসটি উত্তর-পশ্চিম ভারতের জন্য নির্দিষ্ট, তবে বাংলার আবহাওয়াও প্রভাবিত হতে পারে। গত বছর দক্ষিণবঙ্গে এপ্রিল-মে মাসে তীব্র গরম এবং আর্দ্রতার কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়েছিল। এই বছরও যদি তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে, তবে কলকাতা, হাওড়া, বর্ধমান এবং পুরুলিয়ার মতো এলাকায় জনস্বাস্থ্য ও কৃষির উপর প্রভাব পড়তে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ছায়া
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তাপপ্রবাহের দিন বৃদ্ধির পিছনে জলবায়ু পরিবর্তন একটি বড় কারণ। ২০২৪ সালে ভারত ৫৫৪টি তাপপ্রবাহের দিনের সাক্ষী থাকলেও, ২০২৫ সালে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। উত্তর-পশ্চিম ভারতে ধুলোবালি মিশ্রিত বাতাস সাময়িক স্বস্তি দিলেও, দীর্ঘমেয়াদে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে পরিবেশবান্ধব পদক্ষেপ জরুরি। বাংলায়ও গ্রীষ্মে জলসংকট এবং তাপপ্রবাহের প্রভাব মোকাবিলায় প্রস্তুতি শুরু করা প্রয়োজন।
সরকারি প্রস্তুতি ও জনসচেতনতা
তাপপ্রবাহের এই পূর্বাভাসের পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় প্রশাসনের তরফে সতর্কতা জারি করা হতে পারে। জনগণকে পর্যাপ্ত পানি পান, রোদ এড়িয়ে চলা এবং হালকা পোশাক পরার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। বাংলার গ্রামীণ এলাকায়, যেখানে বিদ্যুৎ সংকট এখনও একটি সমস্যা, তাপপ্রবাহের প্রভাব আরও তীব্র হতে পারে।
আইএমডি-র এই সতর্কবার্তা ভারতের গ্রীষ্মকালীন আবহাওয়ার একটি উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরেছে। উত্তর-পশ্চিম ভারতে তাপপ্রবাহের দিন দ্বিগুণ হওয়ার পূর্বাভাস শুধু সেই অঞ্চলের জন্য নয়, বাংলার মতো রাজ্যের জন্যও সতর্কতার বার্তা। জনস্বাস্থ্য রক্ষা এবং পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে সরকারি ও সামাজিক উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি।