“আই লাভ ইউ, (I Love You) এটা সকালের”- গায়ের ছেলে হিরুর বলত। হীরক জয়ন্তী সিনেমার নায়কের মুখে এই সংলাপে তখন হলে সিটি পড়ত। জয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাধ্যমেই প্রিয়জনকে ‘আই লাভ ইউ’ বলতে শিখেছিল বাঙালি। তবে অনেকের কাছেই কথাটি ছিল কটু। যেন অপরাধের সামিল। ৯০-এর দশকের অনেকেই মারধর খেয়েছেন এই তিন শব্দ বলার অপরাধে। কিন্তু ভারতের সংবিধান বলছে, ‘আই লাভ ইউ’ বা ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ বলা কোনও অপরাধ নয়। এটা সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার। বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়েছে ছত্তিশগঢ়ের হাইকোর্ট। ২০২৫ সালের ২৭ জুলাই এই ঐতিহাসিক রায় প্রকাশিত হয়েছে, যা ভারতীয় সমাজে একটি বড় পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে।
রায়ের পটভূমি
ছত্তিশগঢ় হাইকোর্টের এই রায়টি একটি বিশেষ ক্ষেত্রে প্রস্তুত হয়েছে। একটি ক্ষেত্রে একজন ছেলে একজন ১৫ বছর বয়সী মেয়েকে ‘আই লাভ ইউ’ বলার জন্য আইনি জটিলতায় জড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনায় তাকে বিভিন্ন আইন, যেমন POCSO (প্রটেকশন অফ চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্সেস) আইনের অধীনে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। তবে হাইকোর্টের রায়ে এই ধরনের ভুল ব্যাখ্যা থেকে মুক্তি পাওয়া গেছে। আদালতের মতে, ‘আই লাভ ইউ’ বলা একটি সাধারণ বাকস্বাধীনতা (Article 19(1)(a) of the Indian Constitution) এর অধীন এবং তা তখনই অপরাধ হবে যদি এর সঙ্গে হয়রানি, অশ্লীলতা বা হুমকি থাকে। এই রায়টি স্পষ্ট করে দিয়েছে যে ভালোবাসার অভিব্যক্তি নিজে নিজে কোনও আইনি অপরাধ নয়।
বোম্বে হাইকোর্টের সমর্থন
ছত্তিশগঢ় হাইকোর্টের রায়টি একা নয়। ২০২৫ সালেই বোম্বে হাইকোর্ট একটি সদৃশ মামলায় একজন পুরুষকে অব্যাহতি দিয়েছে। এই ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি একই প্রকারের মন্তব্য করেছিলেন, কিন্তু স েখানে কোনও যৌন উদ্দেশ্য বা শারীরিক অশালীনতার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আদালত এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে ভালোবাসার শব্দগুলো যদি শুধুমাত্র আবেগের প্রকাশ হয়, তবে তা আইনের বিরুদ্ধ নয়। এই রায়গুলো ভারতীয় সমাজে চিরকালীন সাংস্কৃতিক বাধা ভাঙতে সাহায্য করছে, যেখানে এই ধরনের অভিব্যক্তি প্রায়শই আইনি বা সামাজিক প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হত।
সামাজিক ও আইনি প্রেক্ষাপট
ভারতীয় সমাজে ‘আই লাভ ইউ’ বলা সবসময়ই একটি সংবেদনশীল বিষয় ছিল। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের মতো এমন অঞ্চলে, যেখানে প্রেম ও সম্পর্ক নিয়ে সংস্কৃতি ও পরিবারের নিয়ম অনেক বেশি প্রভাব ফেলে, এই শব্দগুলো প্রায়শই বিতর্কের কারণ হয়ে ওঠে। ৯০-এর দশকে বা তার আগে, যুবক-যুবতীদের এই কথা বলতে গিয়ে মারধর বা পরিবারের বিরোধের সম্মুখীন হতে হত। তবে আধুনিক যুগে এই রায়গুলো একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আনে। আইনী বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এটি ভারতীয় আইনতত্ত্বে একটি বড় পরিবর্তনের সূচনা, যেখানে ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি ও সামাজিক মর্যাদার সমন্বয় আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
ভারতের সংবিধানে বাকস্বাধীনতার অধিকার ১৯৫১ সালের প্রথম সংশোধনী আইনের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছিল। তখন বাকস্বাধীনতার অপব্যবহার রোধের জন্য কিছু সীমাবদ্ধ তা আরোপ করা হয়েছিল। তবে আজকের এই রায়গুলো সেই সীমাবদ্ধতাকে পুনর্বিবেচনার ক্ষেত্রে নিয়ে যাচ্ছে। আইনী বিশ্লেষকরা বলছেন, এই রায়ের ফলে ভবিষ্যতে প্রেম ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে আইনি বিতর্ক কমতে পারে, তবে এটি এখনও সময়ের পরীক্ষায় রয়েছে। ২০২৫ সালের এই ঘটনা নতুন গবেষণার জন্য উন্মুক্ত, কারণ এর ওপর এখনও পিয়ার-রিভিউড ডেটা প্রকাশিত হয়নি।
সমাজে প্রভাব
এই রায়ের পর বাংলা সিনেমা ও সাহিত্যে ‘আই লাভ ইউ’ বলার দৃশ্য আরও স্বাভাবিক হতে পারে। তবে সমাজে এই পরিবর্তন গ্রহণ করা সহজ হবে না। বাঙালি পরিবারে এখনও প্রেমের অভিব্যক্তি নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। তবে যুবশক্তি এই রায়কে একটি স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে দেখছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে, যেখানে কেউ কেউ বলছেন, “এবার ভালোবাসার কথা বলতে হবে না ভয় পেয়ে।”
ছত্তিশগঢ় হাইকোর্টের রায় ভারতীয় সমাজে একটি নতুন দ্বার খুলে দিয়েছে। ‘আই লাভ ইউ’ বলা এখন অপরাধ থেকে মৌলিক অধিকারে রূপান্তরিত হয়েছে। তবে এই অধিকারের সঠিক ব্যবহার নির্ভর করবে ব্যক্তিদের উপর। আইনী বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন, এই রায় ভবিষ্যতে প্রেম ও সম্পর্ক নিয়ে আইনি সংঘাত কমাবে এবং বাঙালি সমাজে একটি ইতিহাস গড়বে।