প্রযুক্তির অগ্রগতিকে হাতিয়ার করে বড়সড় প্রতারণার জাল পেতেছিল এক চক্র। আধুনিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) নির্ভর শেয়ারবাজার ভবিষ্যদ্বাণীর সফটওয়্যার ও পঞ্জি স্কিমের কৌশল ব্যবহার করে গত কয়েক বছরে একাধিক রাজ্যে ৩,০০০-এরও বেশি বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে ৮৫০ কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। অবশেষে সাইবারাবাদ পুলিশের তৎপরতায় সেই প্রতারণা চক্রের বিরুদ্ধে বড়সড় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। গত ১৯ আগস্ট হায়দরাবাদ থেকে দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, অভিযুক্তদের মধ্যে একজন একটি ভুয়ো সংস্থার ডিরেক্টর এবং অপরজন তারই কর্মী। তাঁরা বিভিন্ন বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে আকর্ষণীয় প্রস্তাব দিয়ে টাকা তুলত। দাবি করা হতো, উন্নত এআই সফটওয়্যারের মাধ্যমে শেয়ারবাজারের ওঠা-নামা নির্ভুলভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব। সেই পূর্বাভাসের ভিত্তিতে প্রতি মাসে ৭ শতাংশ পর্যন্ত নিশ্চিত মুনাফার লোভ দেখানো হতো। মধ্যবিত্ত পরিবার, অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি, চাকরিজীবী— সকলেই এই প্রতারণার ফাঁদে পা দেন।
প্রতারণার অঙ্ক
২০২২ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে এই চক্র মোট ৩,১৬৪ জন বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে ৮৫০.৫৯ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। এর মধ্যে ৬১৮.২৩ কোটি টাকা আংশিকভাবে ফেরত দেওয়া হয়, যাতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বজায় থাকে। কিন্তু ২৩২.৩৬ কোটি টাকা চক্রটি সরাসরি আত্মসাৎ করে।
ভুয়ো সংস্থা ও ওয়েবসাইটের জাল
সাইবারাবাদ পুলিশের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এই প্রতারণা চালাতে মোট চারটি ভুয়ো সংস্থা এবং আটটি ভুয়ো ওয়েবসাইট তৈরি করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, বড় শহরগুলিতে প্রায় ২০ জন কনসালট্যান্ট ও এজেন্ট নিয়োগ করা হয়েছিল। পাশাপাশি সফটওয়্যার ডেভেলপার ও ওয়েবসাইট অ্যাডমিনিস্ট্রেটরদের সাহায্যে ‘প্রফেশনাল’ পরিকাঠামো দাঁড় করানো হয়।
নিয়মিত বিনিয়োগ সেমিনার আয়োজন করা হতো অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানার বিভিন্ন জায়গায়। সেখানে নকল এনএসই/বিএসই সার্টিফিকেট দেখিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করা হতো। এছাড়া চমকপ্রদ ‘প্রিমিয়াম’ অফিস ভাড়া নিয়ে সংস্থাটিকে বৈধ ব্যবসার ছদ্মবেশে চালানো হয়।
কৌশল ও পঞ্জি কাঠামো
পুলিশ জানিয়েছে, এই চক্র পঞ্জি স্কিমের মতো কাঠামো ব্যবহার করত। তোলা টাকার ২০-৩০ শতাংশ সীমিত লেনদেনের নামে ব্যবহার করা হতো, ৪০-৫০ শতাংশ আগের বিনিয়োগকারীদের মুনাফা হিসেবে ফেরত দেওয়া হতো, যাতে নতুন বিনিয়োগকারীরাও আস্থা পান। বাকি অর্থ সরাসরি আত্মসাৎ করা হতো বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য।
নকল ড্যাশবোর্ড তৈরি করে বিনিয়োগকারীদের দেখানো হতো যে তাঁদের অ্যাকাউন্টে কত মুনাফা জমা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে কোনও প্রকৃত শেয়ার লেনদেনই করা হতো না।
টাকার হদিস
অভিযুক্তরা দেশের বিভিন্ন ব্যাঙ্কে ২১টি ‘মিউল অ্যাকাউন্ট’ ব্যবহার করত। এই অ্যাকাউন্টে আসা অর্থ পরে রিয়েল এস্টেট, সোনা ও বিলাসবহুল গাড়ি কেনায় খরচ করা হয়। শুধু তাই নয়, দুবাই-সহ বিদেশে টাকা পাচারেরও ব্যবস্থা ছিল।
ডিজিটাল প্রমাণ মুছে ফেলার চেষ্টা
চক্রটি অত্যন্ত পরিকল্পিত ভাবে কাজ করত। নিয়মিত ডিজিটাল রেকর্ড মুছে ফেলা হতো, যাতে পুলিশ বা রেগুলেটরি সংস্থার কাছে প্রমাণ না থাকে। এমনকি যাঁরা অভিযোগ করার চেষ্টা করেছেন, তাঁদের ভয়-ভীতি দেখানো হয়েছিল। আবার কোনও সময় তদন্ত শুরু হলে দ্রুত ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেওয়া হতো।
পুলিশের বক্তব্য
সাইবারাবাদ পুলিশ কমিশনারেটের তরফে জানানো হয়েছে, গত ২৯ জুলাই এই প্রতারণার মামলায় আনুষ্ঠানিকভাবে এফআইআর দায়ের করা হয়। তারপর থেকেই নজরদারি চালিয়ে অবশেষে ১৯ আগস্ট দু’জনকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে। তবে পুলিশ মনে করছে, এই চক্রের পেছনে আরও বড় নেটওয়ার্ক রয়েছে এবং একাধিক সহযোগী এখনও বেপাত্তা।
সাধারণ মানুষের সতর্কতা
পুলিশের তরফে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। কোনও সংস্থা যদি অস্বাভাবিক হারে মুনাফার প্রতিশ্রুতি দেয়, তবে সেটি প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়। বিশেষ করে এআই-ভিত্তিক বা ক্রিপ্টোকারেন্সি-ভিত্তিক অজানা সংস্থার প্রলোভনে পা না দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
প্রযুক্তির যুগে প্রতারণার ধরণও ক্রমশ আধুনিক হচ্ছে। এক সময় চিঠিপত্র বা ফোনের মাধ্যমে প্রতারণা হলেও এখন এআই এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির সাহায্যে আরও জটিল জাল বিছানো হচ্ছে। ৮৫০ কোটির এই কেলেঙ্কারি আবারও প্রমাণ করল, যথাযথ নিয়ন্ত্রণ ও সচেতনতা ছাড়া সাধারণ মানুষ খুব সহজেই প্রতারণার শিকার হতে পারেন।