পশ্চিমবঙ্গের বাম রাজনীতির ইতিহাসে বারবার উঠে এসেছে ছাত্র আন্দোলনের ভূমিকা। SFI-র ব্যানারে একসময় গর্জে উঠেছিল রাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ। সেই আন্দোলনেরই এক সময়ের সক্রিয় সৈনিক চন্দ্রচূড় ঘোষ (Chandrachur Ghosh)। যিনি শুধু বাম ছাত্র রাজনীতির অংশ ছিলেন না, বরং রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং লেখক হিসেবেও পরিচিত। একদা বাম দূর্গ বর্ধমানের ভূমিপুত্র চন্দ্রচূড় এবার নিজেই প্রশ্ন তুলে দিলেন বাম রাজনীতির বর্তমান অবস্থান ও তার আদর্শ চর্চা নিয়ে।
মঙ্গলবার নিজের ফেসবুক পোস্টে বিস্ফোরক মন্তব্য করেন চন্দ্রচূড়। তাঁর বক্তব্য, আজকের বামপন্থীরা তাঁদের পূর্বসূরীদের আদর্শ ও নীতিকে বিস্মৃত হয়েছেন। আর তার বিপরীতে, বিজেপি এখনও তাঁদের রাজনৈতিক পুরোধা নেতাদের স্মরণ করে ও তাঁদের চিন্তাধারাকে অনুসরণ করে চলে।
🔴 “পড়াশোনা করা কর্মী ছিল আমাদের গর্ব”
চন্দ্রচূড় লেখেন,
“আমি নিজে কংগ্রেস-ছাত্র পরিষদের গড়ে বামপন্থী রাজনীতি করেছি চুটিয়ে, যেখানে অনেক বামপন্থী পরিবারের ছেলেরা ভয়ের চোটে ছাত্র পরিষদ করত। আবার বিশ্বভারতী থেকে বেরিয়ে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে এসএফআই হয়ে যেতো।”
তিনি স্পষ্ট করে বলেন, এক সময়কার ছাত্র রাজনীতির মূল শক্তি ছিল জ্ঞান, যুক্তি এবং সচেতন তর্কের পরিবেশ।
“ছাত্র রাজনীতি করার সময়ে যে ব্যাপারে গর্ব করতাম, এবং রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার পরেও যে কথা মুক্তকন্ঠে স্বীকার করতে কোনও দিন দ্বিধাবোধ করিনি, সেটা হলো যে সাধারণ ছাত্র কর্মী-সমর্থকরাও রীতিমতো পড়াশোনা করত। দেশ-বিদেশের নানা বিষয়ে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তর্ক আলোচনা করতে পারত। সে সব আজ ইতিহাস।”
❌ “আজকের বাম নেতৃত্ব কুতর্ক আর গালিগালাজে ভরসা রাখে”
বর্তমান সময়ের বাম ছাত্র সংগঠনগুলির প্রতি তীব্র আক্রমণ করে চন্দ্রচূড় বলেন,
“এখন যে সব নমুনা দেখতে পাই তারা বেশির ভাগই কুতর্ক আর গালাগাল ছাড়া অন্য কিছু পারে না। সুস্থ তর্ক করা তো অনেক দূরের ব্যাপার। এদের নিয়ে যদি লালের হাল ফেরানোর স্বপ্ন দেখে তাহলে কিছু বলার নেই।”
তাঁর মতে, প্রাক্তন বাম নেতারা যেমন গুরুদাস দাশগুপ্ত, ইন্দ্রজিত গুপ্ত, গীতা মুখার্জী এবং এমনকি সীতারাম ইয়েচুরি — এঁরা আজ প্রায় “স্বপ্নের মতো” মনে হয়, কারণ বর্তমান প্রজন্ম তাঁদের মতাদর্শ বা ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ব্যর্থ।
🟠 “বিজেপি এখনও তাদের ঐতিহ্য মেনে চলে”
চন্দ্রচূড় ঘোষ বিজেপির প্রশংসা করে বলেন,
“অন্যদিকে, বাজপেয়ী, আডবাণী, সুষমা স্বরাজের ঐতিহ্য কিন্তু বিজেপি ধরে রেখেছে।”
তিনি মনে করেন, বিজেপি রাজনৈতিক শিষ্টাচার এবং বুদ্ধিদীপ্ত বিতর্কের ধারাবাহিকতাকে এখনও কিছুটা হলেও রক্ষা করে চলেছে। যে ঐতিহ্য অতীতে ছিলেন বাজপেয়ী-আডবাণীরা, তা আজকের বিজেপি নেতৃত্বের কথাতেও প্রতিফলিত হয়।
📚 চন্দ্রচূড়ের বক্তব্যের প্রভাব
চন্দ্রচূড় ঘোষের এই পোস্ট সোশ্যাল মিডিয়ায় তুমুল চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ কেউ তাঁর সাহসী মন্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছেন, কেউ আবার প্রশ্ন তুলেছেন — এতদিন বাম রাজনীতির অংশ হয়েও আজ তিনি কেন এভাবে বামপন্থীদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছেন?
তবে রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, চন্দ্রচূড় ঘোষের এই মতামত নিছক এক ব্যক্তির হতাশা নয়, বরং সেটি বাংলার বাম রাজনীতির এক বৃহৎ সংকটের প্রতিফলন।
🧭 বামপন্থার ভবিষ্যৎ কোন পথে?
বাংলার বর্তমান রাজনীতিতে বামেরা এখন অনেকটাই কোণঠাসা। তৃণমূলের দাপট এবং বিজেপির উত্থানের মাঝে পুরনো কদর হারিয়েছে একসময়ের ক্ষমতাসীন সিপিএম। এই পরিস্থিতিতে একজন প্রাক্তন SFI নেতার এমন মন্তব্য বাম নেতৃত্বের আত্মসমালোচনার কারণ হয়ে উঠতেই পারে।
তবে এটাও ঠিক, শুধু অতীত স্মরণ করে কোনও রাজনৈতিক দল টিকে থাকতে পারে না। ভবিষ্যতের লড়াইয়ে টিকে থাকতে গেলে, নিজেদের আদর্শকে নতুন প্রজন্মের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা জরুরি।
শেষ কথা, আদর্শ নিয়ে প্রশ্ন তুলে চন্দ্রচূড় ঘোষ কেবল একটি রাজনৈতিক বিশ্লেষণই করলেন না, বরং একটি অস্বস্তিকর বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করালেন বাংলার বামপন্থী রাজনীতিকে। আদর্শই কি হারিয়ে ফেলেছে লাল ঝাণ্ডা? সেই প্রশ্ন আজ আরও জোরালো।