ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে থাকার পটভূমিতে, জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁও সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার পর পাঞ্জাবের ফিরোজপুর ক্যান্টনমেন্টে (Ferozepur Cantonment) রবিবার রাতে একটি পূর্ণ-মাত্রার ব্ল্যাকআউট ড্রিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই ড্রিলটি রাত ৯:০০ থেকে ৯:৩০ পর্যন্ত পরিচালিত হয়, যা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট এবং স্টেশন কমান্ডারের নির্দেশে জরুরি প্রস্তুতি পরীক্ষার জন্য আয়োজিত হয়েছিল। এই ড্রিলটি জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভারতের সতর্কতা এবং প্রস্তুতির একটি অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ব্ল্যাকআউট ড্রিলের বিবরণ
ফিরোজপুর ক্যান্টনমেন্টের সমগ্র এলাকায় এই মক ব্ল্যাকআউট ড্রিলটি বাস্তবায়িত হয়। বাসিন্দাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যেন তারা সম্পূর্ণ অন্ধকার নিশ্চিত করেন, যার মধ্যে ইনভার্টার, জেনারেটর বা যেকোনো বাহ্যিক আলোর উৎস বন্ধ রাখা অন্তর্ভুক্ত ছিল। নিরাপত্তা কর্মকর্তারা লাউডস্পিকারের মাধ্যমে আগাম ঘোষণা দিয়ে জনসাধারণের সহযোগিতা এবং সতর্কতার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। ফিরোজপুর ক্যান্টনমেন্ট থানার স্টেশন হাউস অফিসার (এসএইচও) গুরজন্ত সিং নিশ্চিত করেছেন যে ড্রিলটি পরিকল্পনা অনুযায়ী সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। তিনি বলেন, “সিনিয়র অফিসারদের নির্দেশ অনুযায়ী রাত ৯টা থেকে ৯:৩০ পর্যন্ত সমস্ত আলো বন্ধ রাখা হয়েছিল। হেডলাইট চালু থাকা যানবাহনগুলোকে তা বন্ধ করতে বলা হয়েছিল। পুলিশ পুরোপুরি সতর্ক রয়েছে এবং সমস্ত প্রধান সংযোগস্থলে নিরাপত্তা মোতায়েন করা হয়েছে।”
পহেলগাম হামলা এবং উত্তেজনার পটভূমি
এই ব্ল্যাকআউট ড্রিলটি এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে, যখন জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁও ২২ এপ্রিল একটি ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় ২৬ জন নিহত হয়েছেন। এই হামলার জন্য পাকিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকে দায়ী করা হচ্ছে, যা ভারতের কাছ থেকে কূটনৈতিক এবং সামরিক প্রতিক্রিয়া উসকে দিয়েছে। হামলার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একটি উচ্চ-পর্যায়ের বৈঠকের নেতৃত্ব দেন, যেখানে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল, চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল অনিল চৌহান এবং সেনা, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে সশস্ত্র বাহিনীকে এই জঙ্গি হামলার জবাব দেওয়ার জন্য পূর্ণ অপারেশনাল স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে।
ভারতের কৌশলগত ও কূটনৈতিক পদক্ষেপ
পহেলগাম হামলার পর ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বেশ কিছু কৌশলগত এবং কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে পাকিস্তানিদের জন্য ভিসা স্থগিতকরণ, সীমান্ত বন্ধ, বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা, আকাশপথে নিষেধাজ্ঞা এবং ইন্ডাস ওয়াটার ট্রিটির অস্থায়ী স্থগিতকরণ। এছাড়া, উভয় দেশের কূটনৈতিক কর্মীদের সংখ্যাও কমানো হয়েছে। যদিও কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিক সামরিক পদক্ষেপের বিষয়ে নিশ্চিত করেননি, তবে সীমান্ত পেরিয়ে সন্ত্রাসবাদের জবাবে ভারতের পূর্ববর্তী পদক্ষেপের মতো একটি লক্ষ্যবস্তু অপারেশনের সম্ভাবনা নিয়ে জল্পনা চলছে।
ফিরোজপুরে ব্ল্যাকআউট ড্রিলের তাৎপর্য
ফিরোজপুর, যা ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের কাছে অবস্থিত, তার কৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম। পাঞ্জাবের এই জেলাটি ৫৫৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই ব্ল্যাকআউট ড্রিলটি জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে পরিচালিত হয়েছে, যা সম্ভাব্য সংঘাত বা যুদ্ধের পরিস্থিতিতে প্রস্তুতি এবং স্থিতিস্থাপকতা বাড়ানোর লক্ষ্যে আয়োজিত। এই ধরনের ড্রিল শেষবার পাঞ্জাবে ২০০১ সালের সংসদ হামলার পর অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যা এই ড্রিলের গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
জনগণের প্রতিক্রিয়া এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা
ড্রিলের ঘোষণার পর ফিরোজপুর এবং আশপাশের এলাকায় উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় বাসিন্দারা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র মজুদ করতে শুরু করেছেন, কারণ অনেকে বড় ধরনের কোনো ঘটনার আশঙ্কা করছেন। গুরু হরসহাইয়ের বাসিন্দা অমৃতপাল সিং বলেন, “মানুষ সরবরাহ মজুদ করতে শুরু করেছে, কারণ তারা ভয় পাচ্ছে যে কিছু বড় ঘটনা ঘটতে পারে।” হুসেনিওয়ালার মতো সংবেদনশীল সীমান্ত গ্রামগুলোতেও উত্তেজনা বিরাজ করছে। স্থানীয় একজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করে বলেন, “এখানে অস্থিরতার পরিবেশ। অনেকে, বিশেষ করে শিশুদের পরিবার, এলাকা ছাড়ার কথা ভাবছে।”
নিরাপত্তার দিক থেকে, বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) সীমান্তে টহল জোরদার করেছে, এবং পাঞ্জাব পুলিশ সমস্ত কৌশলগত স্থানে চেকপয়েন্ট স্থাপন করেছে। ফিরোজপুর রেঞ্জের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল হরমনবীর গিল জানিয়েছেন, পুলিশ সমাজবিরোধী উপাদান, চোরাকারবারি এবং অপরাধীদের উপর কড়া নজর রাখছে।
ফিরোজপুর ক্যান্টনমেন্টে এই ব্ল্যাকআউট ড্রিল ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি ভারতের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের একটি প্রতিফলন। পহেলগাম হামলার পর দুই দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সংঘাতের সম্ভাবনা এই ধরনের প্রস্তুতিকে অপরিহার্য করে তুলেছে। ফিরোজপুরের বাসিন্দারা এবং নিরাপত্তা বাহিনী এই ড্রিলে সফলভাবে সহযোগিতা করেছে, যা ভারতের সতর্কতা এবং দৃঢ়তার বার্তা দেয়। ভবিষ্যতে পরিস্থিতি কী দিকে যাবে, তা এখনও অনিশ্চিত, তবে ফিরোজপুরের এই ড্রিল প্রমাণ করে যে ভারত যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত।