ভারতের নির্বাচন কমিশন (ইসিআই) রবিবার একটি গুরুত্বপূর্ণ সভার পর ভোটার আইডি কার্ডের সঙ্গে আধার কার্ড সংযোগের (Voter ID with Aadhaar) সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে। এই পদক্ষেপকে কংগ্রেস দল মহারাষ্ট্রে লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনের মধ্যে ভোটার তালিকায় অমিল নিয়ে তাদের অভিযোগের ফলাফল হিসেবে দেখছে। তবে কংগ্রেস সতর্ক করে বলেছে, এই প্রক্রিয়ায় কোনও যোগ্য নাগরিকের ভোটাধিকার যেন খর্ব না হয় এবং কোনও ব্যক্তির গোপনীয়তা যেন লঙ্ঘিত না হয়।
ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার (ইউআইডিএআই) সিইও, স্বরাষ্ট্র সচিব, আইন সচিব এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মধ্যে রবিবার অনুষ্ঠিত সভার পর কমিশন জানিয়েছে, এই সংযোগ প্রক্রিয়া ভারতীয় সংবিধানের প্রতিনিধিত্ব আইনের ৩২৬ অনুচ্ছেদ এবং সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট রায়ের আলোকে পরিচালিত হবে। কমিশন স্পষ্ট করেছে, ভোটার আইডি (ইপিক) এবং আধারের সংযোগ স্বেচ্ছাধীন হবে। ইতিমধ্যে ৬৫ কোটি মানুষ এই সংযোগ সম্পন্ন করেছেন বলে জানানো হয়েছে।
কংগ্রেস দল এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানালেও সতর্কতার সুরে বলেছে, “নির্বাচন কমিশন কংগ্রেসের উত্থাপিত ‘এক ব্যক্তি, একাধিক ভোটার আইডি’ সমস্যাটি স্বীকার করেছে। আধারের মাধ্যমে ডি-ডুপ্লিকেশনের মাধ্যমে এই সমস্যা দূর করা যাবে।” দলটি গত মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনে মহা বিকাশ আঘাড়ি জোটের পরাজয়ের পর অভিযোগ করেছিল যে, লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনের মধ্যে পাঁচ মাসে নতুন ভোটারের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। তারা ইঙ্গিত দিয়েছিল, এই ভোটাররা ভুয়ো, ডুপ্লিকেট বা ‘ভূতুড়ে’ ভোটার হতে পারে।
Also Read | ‘পালিয়ে আসতে চাইছি…’ তৃণমূলের সাংসদের মন্তব্যে দল বদলের জল্পনা!
নির্বাচন কমিশন এই সমস্যা সমাধানে ডুপ্লিকেট ইপিক নম্বর বাতিলের জন্য তিন মাসের সময়সীমা নির্ধারণ করেছে। কমিশন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে নাগরিকত্বের বিষয়ে কাজ করবে, যাতে পরিচয়ের সমস্যা সমাধান করে প্রকৃত ভোটারদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা যায়। কমিশন মন্ত্রণালয়ের কাছে এই বিষয়ে পরামর্শ চেয়েছিল, এবং এখন তারা যৌথভাবে এই সমাধানে কাজ করবে।
কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এই সিদ্ধান্তের পর এক্স-এ একটি পোস্টে বলেন, “নির্বাচন কমিশন যখন এই সমস্যা স্বীকার করেছে, তখন আমি আমার পূর্বের দাবি পুনর্ব্যক্ত করছি। কমিশনের উচিত ভোটার তালিকায় যোগ-বিয়োগের বিষয়টিও সমাধান করা। প্রথমে মহারাষ্ট্র ২০২৪ বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচনের সম্পূর্ণ ভোটার ছবির তালিকা প্রকাশ্যে প্রকাশ করা হোক।” তিনি এই দাবির মাধ্যমে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার উপর জোর দিয়েছেন।
আধার-ভোটার আইডি সংযোগ নিয়ে আইনি ও নৈতিক বিতর্ক দীর্ঘদিনের। ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট আধার আইনের সাংবিধানিক বৈধতা বহাল রাখলেও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট এবং মোবাইল সংযোগের সঙ্গে আধারের বাধ্যতামূলক সংযোগ বাতিল করে দেয়। তবে সরকারি ভর্তুকি ও কল্যাণ প্রকল্পের জন্য আধার-ব্যাঙ্ক সংযোগের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এই রায়ের আলোকে কমিশন জানিয়েছে, ভোটার আইডি-আধার সংযোগ সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাধীন থাকবে। তবে এটি নাগরিকত্ব নিশ্চিত করে না, কারণ সংবিধানের ৩২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ভোটাধিকার শুধুমাত্র ভারতীয় নাগরিকদের জন্য, যাঁরা ভারতের মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছেন। আধার শুধুমাত্র বায়োমেট্রিক এবং ঠিকানার মাধ্যমে পরিচয় নিশ্চিত করে।
Today the Election Commission of India has announced it will link Aadhaar with voter IDs.
The Congress and INDIA parties have been repeatedly raising issues of voter lists, including abnormally high additions, unexpected deletions and duplicate voter ID numbers.
While Aadhar… https://t.co/WR83vnC5IT
— Rahul Gandhi (@RahulGandhi) March 18, 2025
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, শীঘ্রই ইউআইডিএআই এবং কমিশনের বিশেষজ্ঞদের মধ্যে প্রযুক্তিগত আলোচনা শুরু হবে। এই প্রক্রিয়ায় ভোটার তালিকা থেকে ডুপ্লিকেট এন্ট্রি বাদ দেওয়া এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা বাড়ানোই মূল লক্ষ্য। কমিশনের এক কর্মকর্তা বলেন, “আমরা এমন একটি ব্যবস্থা গড়তে চাই যাতে প্রতিটি প্রকৃত ভোটার ভোট দিতে পারেন এবং কোনও ভুয়ো ভোটার তালিকায় না থাকে।”
কংগ্রেসের অভিযোগের প্রেক্ষাপটে এই সিদ্ধান্ত এসেছে। মহারাষ্ট্রে গত লোকসভা নির্বাচনে (এপ্রিল-মে ২০২৪) এবং বিধানসভা নির্বাচনে (নভেম্বর ২০২৪) ভোটার সংখ্যার তফাত নিয়ে দলটি প্রশ্ন তুলেছিল। তারা দাবি করেছিল, পাঁচ মাসে প্রায় ১৫ লক্ষ নতুন ভোটার যোগ হওয়া সন্দেহজনক। কংগ্রেস মনে করে, এই ভোটারদের মধ্যে অনেকেই ডুপ্লিকেট বা ভুয়ো হতে পারে, যা নির্বাচনের ফলাফলের উপর প্রভাব ফেলেছে। দলটির নেতা জয়রাম রমেশ বলেন, “এই সিদ্ধান্ত আমাদের অভিযোগের প্রতিফলন। তবে কমিশনকে নিশ্চিত করতে হবে যে এই প্রক্রিয়া স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ থাকে।”
এই সিদ্ধান্ত নির্বাচনী সংস্কারের একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে এটি নিয়ে বিতর্কও শুরু হয়েছে। বিজেপি নেতা রবি শঙ্কর প্রসাদ বলেন, “আধার সংযোগ ভোটার তালিকাকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করবে। কংগ্রেসের অভিযোগ ভিত্তিহীন।” অন্যদিকে, তৃণমূল কংগ্রেসের মতো দলগুলো গোপনীয়তা লঙ্ঘনের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। তৃণমূল নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন বলেন, “আধারের অপব্যবহার হতে পারে। কমিশনের উচিত এই বিষয়ে জনগণের মতামত নেওয়া।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আধার-ভোটার সংযোগ ডুপ্লিকেট ভোটার সমস্যা সমাধানে কার্যকর হলেও নাগরিকত্ব যাচাইয়ের জন্য আলাদা ব্যবস্থা প্রয়োজন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ বলেন, “আধার কেবল পরিচয় নিশ্চিত করে, নাগরিকত্ব নয়। এটি সীমান্তবর্তী এলাকায় সমস্যা তৈরি করতে পারে।” তিনি সতর্ক করে বলেন, স্বেচ্ছাধীন হলেও এটি পরোক্ষভাবে বাধ্যতামূলক হয়ে উঠতে পারে।
এই সিদ্ধান্ত ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থায় একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে। তবে এর সাফল্য নির্ভর করবে কমিশনের স্বচ্ছতা এবং জনগণের আস্থার উপর। ভোটাররা এখন অপেক্ষায় আছেন, এই প্রক্রিয়া কীভাবে তাদের ভোটাধিকারকে প্রভাবিত করে।