শিল্পপতি অনিল ধীরুভাই আম্বানির সঙ্গে সম্পর্কিত একাধিক সংস্থার বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগে বৃহস্পতিবার মুম্বাইয়ের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়েছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) (ED Raids)। এই অভিযান এমন সময় হলো, যখন রাষ্ট্রায়ত্ত স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া (SBI) সম্প্রতি অনিল আম্বানি এবং তাঁর সংস্থা রিলায়েন্স কমিউনিকেশনস (RCom)-কে ‘জালিয়াত’ হিসেবে ঘোষণা করেছে।
ইডির এই তল্লাশি অভিযান চলেছে দিল্লি ও মুম্বাই শাখার একাধিক অফিসারের উপস্থিতিতে। যদিও অনিল আম্বানির ব্যক্তিগত বাসভবনে কোনও অভিযান চালানো হয়নি, তবে তাঁর মালিকানাধীন রিলায়েন্স অনিল আম্বানি গ্রুপ (RAAGA)-এর সঙ্গে যুক্ত একাধিক সংস্থার কার্যালয়ে তল্লাশি চালানো হয়।
বহু সংস্থা ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান:
সূত্রের খবর অনুযায়ী, ইডি এই পদক্ষেপ নেয় একাধিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও আর্থিক সংস্থার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে। এর মধ্যে রয়েছে ন্যাশনাল হাউসিং ব্যাংক, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া (SEBI), ন্যাশনাল ফিনান্সিয়াল রিপোর্টিং অথরিটি (NFRA), ব্যাংক অফ বরোদা এবং সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (CBI)-এর দায়ের করা দুটি এফআইআরের তথ্য।
তদন্তকারীদের অভিযোগ, অনিল আম্বানির সংস্থাগুলি একটি সংগঠিতভাবে জনসাধারণের অর্থ অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ার কৌশল নিয়েছিল। এই অর্থ পাচারকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন একাধিক ব্যাংক, শেয়ারহোল্ডার, বিনিয়োগকারী ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
ইয়েস ব্যাংক ঋণকাণ্ডে নতুন মোড়:
এই তদন্তের কেন্দ্রে রয়েছে ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ইয়েস ব্যাংক থেকে নেওয়া প্রায় ₹৩,০০০ কোটির ঋণ। ইডির দাবি, এই ঋণ সরকারি ভাবে রিলায়েন্স গ্রুপের হাতে যাওয়ার আগেই বিপুল অঙ্কের টাকা সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল এমন কিছু সংস্থার কাছে, যেগুলির সঙ্গে ব্যাংকের প্রোমোটারদের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল বলে সন্দেহ।
এছাড়া, প্রাক্তন ইয়েস ব্যাংক আধিকারিকদের সঙ্গে সম্ভাব্য ঘুষ-লেনদেন সংক্রান্ত বিষয়েও তদন্ত চলছে। ইডি সূত্রে জানা গেছে, রিলায়েন্স হোম ফাইনান্স লিমিটেড (RHFL)-এর আর্থিক লেনদেন সম্পর্কেও বিস্তৃত অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে। এক বছরে ওই সংস্থার কর্পোরেট ঋণ বিতরণ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাওয়াকে (২০১৭-১৮ সালে ₹৩,৭৪২.৬০ কোটি থেকে ২০১৮-১৯ সালে ₹৮,৬৭০.৮০ কোটি) ‘অস্বাভাবিক বৃদ্ধি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
অনিল আম্বানিকে SBI-এর ‘জালিয়াত’ ঘোষণা:
তদন্তে মোড় নেয় যখন ১৩ জুন, ২০২৫-এ স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া (SBI) আনুষ্ঠানিকভাবে রিলায়েন্স কমিউনিকেশনস ও তার প্রোমোটার অনিল আম্বানিকে ‘জালিয়াত’ হিসেবে ঘোষণা করে। ব্যাংকটি এই ঘোষণা করে রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার জালিয়াতি ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত নির্দেশিকা অনুসারে। পরে ২৪ জুন RBI-কে এ বিষয়ে রিপোর্টও পাঠানো হয়।
জানা গেছে, SBI এখন সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনের (CBI) কাছে একটি বিস্তারিত অভিযোগ দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর মাধ্যমে একটি বৃহৎ আর্থিক অপরাধ চক্রের জট খুলে যেতে পারে বলে মনে করছে তদন্তকারী সংস্থা।
কর্পোরেট জালিয়াতির আড়ালে আরও বড় চক্র?
অভিযোগ, অনিল আম্বানির সংস্থাগুলি শুধুমাত্র ব্যাংক ঋণ নয়, বিনিয়োগকারীদেরও বিভ্রান্ত করেছে। নিরীক্ষা সংস্থা ও অন্যান্য নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করা আর্থিক তথ্য গোপন করা হয়েছে বা বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তদন্তে উঠে এসেছে একাধিক লেয়ার্ড কোম্পানির নাম, যেগুলোর মাধ্যমে তহবিল স্থানান্তর করা হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি এই অভিযোগগুলি প্রমাণিত হয়, তবে এটি স্বাধীন ভারতের কর্পোরেট ইতিহাসে অন্যতম বড় জালিয়াতি মামলায় পরিণত হতে পারে। ইডি ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় ব্যবসা-সম্পর্কিত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে।
ভবিষ্যৎ কী?
বর্তমানে ইডির তদন্ত চলছে এবং আগামী দিনে আরও তথ্য সামনে আসতে পারে। তদন্তের অগ্রগতি অনুযায়ী অনিল আম্বানি বা অন্য কোনও শীর্ষ কর্তা ব্যক্তির বিরুদ্ধে সরাসরি আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে।
এই ঘটনার মাধ্যমে আরও একবার প্রমাণিত হলো, বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলিও আইনের ঊর্ধ্বে নয়, এবং কোনওভাবেই জনসাধারণের অর্থের অপব্যবহার সহ্য করা হবে না। ইডির এই পদক্ষেপ দেশের আর্থিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উপর সাধারণ মানুষের আস্থা আরও বাড়াবে বলেই মনে করা হচ্ছে।