পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার (Indo-Pak Tensions) প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে মহড়া (মক ড্রিল) পরিচালনার জন্য দিল্লি পুলিশ ব্যাপক প্রস্তুতি শুরু করেছে। দিল্লি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সমস্ত ডেপুটি কমিশনার অফ পুলিশ (ডিসিপি)-কে এই মহড়ার জন্য বিস্তারিত পরিকল্পনা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন। এই পদক্ষেপ জাতীয় রাজধানীতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার লক্ষ্যে গৃহীত হয়েছে, যা পহেলগাঁও হামলার পর দেশজুড়ে বর্ধিত হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
দিল্লিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার
নিউজ এজেন্সি পিটিআই-এর সূত্রে জানা গেছে, দিল্লি পুলিশের ডিসিপিরা জাতীয় রাজধানীতে টহল ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করতে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক শুরু করেছেন। একটি সূত্র জানিয়েছে, “আমরা ইতিমধ্যে শহরে দিন ও রাতের টহল বাড়িয়েছি। হরিয়ানা এবং উত্তর প্রদেশের সঙ্গে দিল্লির সীমান্তে প্যারামিলিটারি বাহিনী এবং পুলিশ কর্মীদের মোতায়েন করা হয়েছে। শহরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ইতিমধ্যে জোরদার করা হয়েছে। ডিসিপিরা তাদের নিজ নিজ জেলায় ব্যবস্থাপনার তদারকি করছেন এবং সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসিপি) এবং থানার ইনচার্জদের (এসএইচও) সঙ্গে বৈঠক করছেন।”
২২ এপ্রিল পহেলগাঁওয়ে সংঘটিত জঙ্গি হামলা, যাতে ২৬ জন, অধিকাংশই পর্যটক, নিহত হয়েছেন, তা দেশব্যাপী হুমকির মাত্রা বাড়িয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে দিল্লি পুলিশ কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, যার লক্ষ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং জনসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “সমস্ত জেলার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে মাঠপর্যায়ে মোতায়েন তদারকি করছেন। তারা এসিপি এবং এসএইচওদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছেন এবং তাদের দলকে নির্দেশ দিচ্ছেন যাতে থানা পর্যায়ে সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। তাদের ক্রমাগত মাঠে উপস্থিতি অপারেশনাল দক্ষতা বাড়ায় এবং কর্মীদের এবং জনসাধারণের উদ্বেগগুলি দ্রুত সমাধান করে।”
টহল বৃদ্ধি ও বিশেষ নজরদারি
দিল্লিতে সার্বক্ষণিক নজরদারি নিশ্চিত করতে পায়ে টহল ব্যবস্থা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো হয়েছে, বিশেষ করে সন্ধ্যা এবং রাতের সময়। কনট প্লেস, ইন্ডিয়া গেট, জনপথ, যশবন্ত প্লেস, গোল মার্কেট এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলিতে বিশেষ টহল ইউনিট মোতায়েন করা হয়েছে। উচ্চ জনসমাগম এলাকায় মোটরসাইকেল টহল এবং বিশেষ পিকেটের মাধ্যমে পুলিশের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হচ্ছে। একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “আমরা ইন্টারেকটিভ পুলিশিংয়ের উপর জোর দিচ্ছি, যেখানে বিট অফিসাররা দোকানদার, যাত্রী এবং বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে তাদের উদ্বেগ সমাধান করছেন এবং সতর্কতা বাড়াচ্ছেন।”
মহড়ার সময় বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল (বিডিএস) এবং কুকুর স্কোয়াডের মোতায়েন নিশ্চিত করা হবে। পলিকা বাজার, জনপথ, খান মার্কেট এবং সরকারি ভবনের কাছাকাছি উচ্চ জনসমাগম এলাকায় ক্রমাগত অ্যান্টি-স্যাবোটাজ চেক চালানো হবে। কর্মকর্তা আরও জানান, কঠোর সন্ত্রাসবিরোধী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, যানবাহন পরীক্ষার অভিযান চলছে এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ পয়েন্টে একাধিক পিকেট এবং চেকপোস্ট স্থাপন করা হয়েছে।
যানবাহন পরীক্ষা ও সন্দেহজনক ব্যক্তিদের উপর নজর
দিল্লি পুলিশ সন্দেহজনক ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে ব্যাপক যানবাহন পরীক্ষা চালাচ্ছে। কর্মীদের ভাড়া দেওয়া এবং নিবন্ধনবিহীন যানবাহনের উপর বিশেষ নজর রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একজন কর্মকর্তা বলেন, “আমরা সন্দেহজনক যানবাহন এবং ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে কঠোর পরীক্ষা চালাচ্ছি। এই প্রক্রিয়ায় কোনো ত্রুটি রাখা হচ্ছে না।”
স্থানীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে সমন্বয়
দিল্লি পুলিশ রেসিডেন্ট ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন (আরডব্লিউএ), মার্কেট ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন (এমডব্লিউএ), নাগরিক সুরক্ষা সমিতি এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় মোতায়েন বেসরকারি নিরাপত্তা প্রহরীদের সঙ্গে বৈঠক করছে। এই গোষ্ঠীগুলিকে সতর্ক থাকার এবং কোনো সন্দেহজনক কার্যকলাপ তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশের কাছে রিপোর্ট করার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করা হচ্ছে। কর্মকর্তা জানান, “এই গোষ্ঠীগুলি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করা হয়েছে এবং কোনো উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিকভাবে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।”
মহড়ার পরিকল্পনা ও লক্ষ্য
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুসারে, ৭ মে বিভিন্ন রাজ্যে নাগরিক প্রতিরক্ষার জন্য মহড়া পরিচালিত হবে। দিল্লিতে এই মহড়ার মধ্যে এয়ার রেইড সাইরেন চালু করা এবং শত্রুপক্ষের হামলার ক্ষেত্রে নাগরিকদের নিজেদের সুরক্ষার প্রশিক্ষণ দেওয়া অন্তর্ভুক্ত থাকবে। রাজ্যগুলিকে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা আপডেট করতে, ক্র্যাশ ব্ল্যাকআউট ব্যবস্থা প্রশিক্ষণ দিতে এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলির প্রাথমিক ছদ্মবেশের ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দিল্লি পুলিশ এই মহড়ার জন্য বিস্তারিত পরিকল্পনা তৈরি করছে, যাতে সমস্ত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার এবং জনসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
পহেলগাঁও হামলার প্রেক্ষাপট
২২ এপ্রিল পহেলগাঁওয়ের বাইসারান উপত্যকায় জঙ্গি হামলায় ২৬ জন নিহত হন, যাদের অধিকাংশই ছিলেন পর্যটক। এই হামলার জন্য ভারত পাকিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বার প্রক্সি সংগঠন দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ)-কে দায়ী করেছে। যদিও পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জানিয়েছে, ভারত একাধিক শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে ইন্দুস জল চুক্তি স্থগিত করা, আটারি সীমান্ত বন্ধ করা এবং পাকিস্তানি নাগরিকদের ভিসা বাতিল। এই ঘটনা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ককে নতুন সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, রাশিয়া, জাপান এবং অন্যান্য দেশ পহেলগাঁও হামলার নিন্দা জানিয়েছে এবং ভারতের সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে সমর্থন প্রকাশ করেছে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ সতর্ক করে বলেছেন, ভারত নিয়ন্ত্রণ রেখায় যে কোনো সময় হামলা চালাতে পারে, এবং পাকিস্তান “যথাযথ জবাব” দেবে। এই পরিস্থিতিতে দিল্লির নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
পহেলগাঁও হামলার পর ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে দিল্লি পুলিশের নিরাপত্তা জোরদার এবং মহড়ার প্রস্তুতি জাতীয় রাজধানীতে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পরিচালিত এই মহড়া এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেশের সার্বিক প্রস্তুতির অংশ। দিল্লি পুলিশের এই প্রচেষ্টা, স্থানীয় সম্প্রদায়ের সহযোগিতা এবং কঠোর নজরদারির মাধ্যমে জাতীয় রাজধানীকে সুরক্ষিত রাখার প্রতিশ্রুতি স্পষ্ট। তবে, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের অস্থিতিশীলতা এবং সম্ভাব্য হুমকির প্রেক্ষাপটে এই ব্যবস্থাগুলি কতটা কার্যকর হবে, তা ভবিষ্যতের ঘটনাপ্রবাহের উপর নির্ভর করবে।