লালকেল্লার পার্কিং লটে পুলিশকর্মী ‘থান সিংহ কি পাঠশালা’য় স্বপ্ন দেখছে ১০০ শিক্ষার্থী

Delhi Cop Than Singh's Free Pathshala: 100+ Slum Kids Learn Near Red Fort

দিল্লির ঐতিহাসিক লালকেল্লার প্রাঙ্গণে প্রতিদিন বিকেলে এক অসাধারণ দৃশ্য দেখা যায়। ব্যস্ত ভিড় এবং উঁচু দেয়ালের কাছাকাছি, সাই বাবা মন্দিরের পার্কিং এলাকায় স্কুল ব্যাগ কাঁধে করে ডজনখানেক শিশু জড়ো হয়। তাদের গন্তব্য কোনো ঐতিহ্যবাহী স্কুল নয়—বরং ‘থান সিংহ কি পাঠশালা’ (Than Singh Ki Pathshala), যা দিল্লি পুলিশের হেড কনস্টেবল থান সিংহের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি খোলা আকাশের নিচে ক্লাসরুম। এই উদ্যোগের মাধ্যমে দিল্লির বস্তি এলাকার প্রায় ৮০ শিশু, যারা আগে ফালতু কাজ যেমন কাগজ সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করত, এখন পড়াশোনা করতে পারছে। থান সিংহের নিষ্ঠাবান প্রচেষ্টাই এই পরিবর্তন ঘটিয়েছে।

Advertisements

থান সিংহের জীবনীতি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত। রাজস্থানের ভরতপুরের বস্তিতেে জন্মগ্রহণ করে দিল্লির বস্তিে বেড়ে ওঠা সিংহের বাবা রাস্তায় কাপড় ইস্ত্রি করে জীবন যাপন করতেন, আর ছোটবেলায় সিংহ নিজে রাস্তায় ভুট্টা বিক্রি করত। তবু, তিনি পড়াশোনাকে কখনো হালকাভাবে নেননি। “আমার স্কুল ফি ছিল মাত্র ৩ টাকা। বাবা পুলিশ অফিসার হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পরিবারের দায়িত্বে তা সম্ভব হয়নি। আমি তার স্বপ্ন পূরণ করতে দিল্লি পুলিশের পরীক্ষায় দু’বার চেষ্টা করে ২০০৯ সালে সফল হয়ে ২০১০ সালে চাকরি পাই,” সিংহ ‘দ্য বেটার ইন্ডিয়া’-কে বলেন। ২০১৩ সালে লাল কেল্লার কাছে রাগপিকিং করতে দেখা শিশুদের দেখে তার শৈশবের স্মৃতি জেগে ওঠে। তাই, ২০১৫ সালে মন্দিরের প্রাঙ্গণে শুরু করে পাঠশালা, যা প্রথমে মাত্র ৫ শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু হয় এবং এখন ১০০-এর বেশি শিক্ষার্থী এবং ৫০ স্বেচ্ছাসেবকের সাথে চলছে।

   

এই পাঠশালার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল অভিভাবকদের বিশ্বাস অর্জন। “এই শিশুদের বাবা-মা নিম্ন আয়ের গোষ্ঠী থেকে। প্রথমে তারা স্কুলে পাঠানোর ভয় পেয়ে যেত। তাই আমি তাদের ভয় দূর করার সিদ্ধান্ত নিই,” সিংহ বলেন। নিয়মিত কথোপকথনের মাধ্যমে তিনি তাদের শিক্ষার মূল্যবোধ এবং শিশুদের ভবিষ্যত গঠনে এর ভূমিকা বোঝান। ফলে, রাজঘাট, বিজয়ঘাট, শান্তিবান, লোহে-ওয়ালা-পুলের মতো বস্তি এলাকার শিশুরা এখন নিয়মিত ক্লাসে যোগ দেয়। ৩ থেকে ১৫ বছরের শিশুরা প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে ৫:৩০টা পর্যন্ত, রবিবারসহ সপ্তাহের সাত দিন ক্লাস করে। স্বেচ্ছাসেবকদের সাথে ব্যাটারি রিকশা চালকরাও সাহায্য করেন, শিশুদের ঘর থেকে পাঠশালায় নিয়ে আসেন।

পাঠশালার ফলাফল ইতিমধ্যে দৃশ্যমান। ফর্মাল স্কুলে ভর্তির পর ৯ জন শিক্ষার্থী ক্লাস টপার হয়েছে। “এই শিশুরা প্রমাণ করেছে যে যারা বলত তারা কিছু অর্জন করতে পারবে না, তারা ভুল,” সিংহ গর্ব করে বলেন। গত বছর ৭০ জন শিক্ষার্থী সরকারি স্কুলে ভর্তি হয়েছে, যাদের মধ্যে ১০ জন সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে। শিক্ষার্থীরা এখানে স্বপ্ন দেখে। এক তরুণী শিক্ষার্থী বলে, “আমি আইপিএস অফিসার হতে চাই, এবং এই স্কুলে আইপিএস-এর প্রস্তুতি নেব।” অন্য একজন, অজয় আহিরওয়াল, যার বাবা পর্যটন স্পটে শ্রমিক, বলে, “সোশ্যাল সায়েন্স আমার সবচেয়ে পছন্দের বিষয়, এবং আমি থান সিংহ চাচার মতো পুলিশ অফিসার হয়ে শিশুদের পড়াব।”

এই উদ্যোগ সম্পূর্ণ ডোনেশনের উপর চলে, কোনো ফি নেয় না। থান সিংহ বলেন, “যদি আপনি সাহায্য করতে চান, তাহলে শিশুদের সাথে দেখা করুন। যা দিতে চান, সরাসরি তাদের দিন।” ২০২৫ সালের মার্চ মাসে নিউজএক্স-এর রিপোর্ট অনুসারে, পাঠশালায় এখন ২০০ শিক্ষার্থী, যার মধ্যে ৬ বছরের কর্ম চাঁদের মতো শিশু যারা আগে কখনো স্কুলে যায়নি, এখন শিক্ষার মূল্য বুঝেছে। অনুরাধার মতো শিক্ষার্থী বলেন, থান সিংহ তাদের ঘর ধ্বংসের পর আশ্রয়, খাবার এবং কাপড় দিয়েছেন। কোভিড-১৯-এর সময় মাস্ক, স্যানিটাইজার এবং সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং মেনটেন করে ক্লাস চালানো হয়েছে।

Advertisements

থান সিংহের সিনিয়ররাও সাহায্য করেছেন, আর্থিক সহায়তা দিয়ে। তিনি বলেন, “আমার লক্ষ্য এই শিক্ষার্থীদের সঠিক-ভুল বোঝাতে এবং তাদের বাবা-মাকে সাহায্য করতে শেখানো।” টাইমস অফ ইন্ডিয়ার ২০২০ রিপোর্টে বলা হয়েছে, সিংহ প্রতিদিন ডিউটি শেষ করে সন্ধ্যা ৫টায় ক্লাস শুরু করেন, যা এখনও চলছে। আইএন নিউজের জুন ২৫ রিপোর্টে উল্লেখ, পাঠশালা ২০১৫ সাল থেকে চলছে এবং শিশুরা এখন তাদের বয়সের সাথীদের সাথে পাল্লা দিতে পারছে। ফ্রি প্রেস জার্নালের ২০২৩ রিপোর্টে বলা, এটি ক্রাউডফান্ডিং এবং ডোনারদের সাপোর্টে চলে, যা শিশুদের অপরাধ এবং শ্রমের জীবন থেকে মুক্ত করে।

থান সিংহ কি পাঠশালা শুধু শিক্ষা নয়, বরং একটি সম্প্রদায়ের গল্প। এখানে শিশুরা মোরাল ভ্যালু শেখে, বাস-রিকশা-দোকানের নাম চিনতে শেখে এবং স্বনির্ভর হয়। সিংহ বলেন, “পুলিশের কাজ মানুষের কাছে যাওয়া, তাদের সমস্যা বোঝা।” এই উদ্যোগ দিল্লির মতো বড় শহরে শিক্ষার অসমতুল্যতা কমাতে অনুপ্রেরণা যোগায়। ২০২৪ সালের এপ্রিলে দ্য বেটার ইন্ডিয়ার রিপোর্টে ভিডিওতে দেখানো হয়েছে, কীভাবে শিশুরা লাল কেল্লার পার্কিংয়ে জড়ো হয়। গুড নিউজ নেটওয়ার্কের ২০২৩ রিপোর্টে বলা, ৭০ শিক্ষার্থী স্কুলে ভর্তি হয়েছে।

এই পাঠশালা প্রমাণ করে যে একজনের প্রচেষ্টা কতটা পরিবর্তন আনতে পারে। থান সিংহের মতো ব্যক্তিরা শিক্ষাকে অ্যাক্সেসিবল করে, শিশুদের স্বপ্নের পথ খুলে দেন। যারা সাহায্য করতে চান, তারা লাল কেল্লার সাই বাবা মন্দিরে এসে শিশুদের সাথে দেখা করতে পারেন। এই উদ্যোগ ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থায় আশার আলো জ্বালিয়েছে, যা এক শিশু করে এক শিশু এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।