হায়দরাবাদ: অন্ধ্রপ্রদেশের উপকূলে আছড়ে পড়ার পর ধীরে ধীরে দুর্বল হয়েছে ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড় ‘মন্থা’ (Mon-Tha)। বুধবার ভোররাতের পর ভারতের আবহাওয়া দফতর (IMD) জানায়, মারাত্মক ঘূর্ণিঝড় ‘সিভিয়ার সাইক্লোনিক স্টর্ম’ থেকে এটি এখন সাধারণ ‘সাইক্লোনিক স্টর্ম’-এ পরিণত হয়েছে। তবে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে অন্ধ্র উপকূলজুড়ে চলছে প্রবল বৃষ্টি ও ঝোড়ো হাওয়ার দাপট।
আবহাওয়া দফতরের রাত আড়াইটের আপডেট অনুযায়ী, ঝড়টি উপকূলীয় অন্ধ্রপ্রদেশে স্থলভাগে প্রবেশের পর উত্তর-পশ্চিম দিকে ঘণ্টায় প্রায় ১০ কিমি বেগে অগ্রসর হয়। বর্তমানে ঝড়ের কেন্দ্র নারসাপুরের প্রায় ২০ কিমি পশ্চিম-উত্তরপশ্চিমে, মাচিলিপটনমের ৫০ কিমি উত্তরপূর্বে এবং কাকিনাডার ৯০ কিমি পশ্চিম-দক্ষিণপশ্চিমে অবস্থান করছে। ডপলার রাডারের মাধ্যমে ক্রমাগত তার গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
ভারি বৃষ্টি ও গাছ উপড়ে পড়ায় বিপর্যস্ত একাধিক জেলা
ঝড়ের ফলে পশ্চিম গোদাবরী, কৃষ্ণা ও পূর্ব গোদাবরী জেলার বহু এলাকায় ভারি বৃষ্টি এবং ঝোড়ো হাওয়ায় গাছ উপড়ে পড়েছে, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে। নিম্নাঞ্চলগুলিতে বন্যার আশঙ্কায় জারি হয়েছে সতর্কতা। মঙ্গলবার রাত থেকেই উপকূল জুড়ে প্রবল বৃষ্টির সঙ্গে ঘণ্টায় ৮০-৯০ কিমি বেগে বইছে ঝড়ো হাওয়া।
রাতভর যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা Cyclone Montha weakens
অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার সাতটি জেলায়—কৃষ্ণা, এলুরু, পূর্ব ও পশ্চিম গোদাবরী, কাকিনাডা, ডঃ বি.আর. আম্বেদকর কোনাসীমা এবং অলুরি সীতারাম রাজু জেলার কিছু অংশে রাত সাড়ে আটটা থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত যান চলাচলে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। শুধুমাত্র জরুরি চিকিৎসা পরিষেবাকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, জাতীয় সড়ক সহ সমস্ত রাস্তায় গাড়ি চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে।
বৃষ্টি ও বাতাসে প্রাণহানি, বিমান–রেল পরিষেবা ব্যাহত
কোনাসীমা জেলার মাকানাগুডেম গ্রামে এক মহিলার মৃত্যু হয়েছে গাছ পড়ে। প্রবল বৃষ্টিতে বিমান ও ট্রেন পরিষেবাতেও প্রভাব পড়েছে—বিশাখাপত্তনম বিমানবন্দরে ৩২টি, বিজয়ওয়াড়ায় ১৬টি এবং তিরুপতিতে ৪টি ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। অন্যদিকে দক্ষিণ-মধ্য রেলওয়ে (SCR) অঞ্চলে সোমবার ও মঙ্গলবার মিলিয়ে ১২০টি ট্রেন বাতিল করা হয়েছে। রিলিফ অ্যান্ড রেসকিউ-র জন্য NDRF-এর ৪৫টি দল ইতিমধ্যেই বিভিন্ন উপকূলীয় জেলায় মোতায়েন রয়েছে।
প্রস্তুত প্রতিবেশী ওড়িশা, ১১ হাজারের বেশি মানুষকে সরানো হল নিরাপদ স্থানে
অন্ধ্রপ্রদেশের পাশের রাজ্য ওড়িশা-তেও জারি হয়েছে উচ্চ সতর্কতা। মুখ্যমন্ত্রী মোহন চরণ মাঝি জানিয়েছেন, ঝড়ের সম্ভাব্য প্রভাবে আটটি দক্ষিণ জেলা জুড়ে খোলা হয়েছে ২,০৪৮টি বিপর্যয় ত্রাণ কেন্দ্র, যেখানে ইতিমধ্যে ১১,৩৯৬ জন মানুষকে সরিয়ে আনা হয়েছে। দেওমালি ও মহান্দ্রগিরি পাহাড়ের মতো পর্যটনকেন্দ্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। উপকূলবর্তী সৈকত এলাকাতেও পর্যটন রুদ্ধ।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে নয়টি জেলায়, সরকারি কর্মীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত।
ওড়িশার একাধিক জেলায় ভারি বৃষ্টির সতর্কতা
আইএমডি জানিয়েছে, মঙ্গলবারের জন্য মালকানগিরি, করাপুট, রায়গড়া, গজপতি ও গঞ্জাম জেলায় জারি করা হয়েছে ‘রেড অ্যালার্ট’, অর্থাৎ অতি ভারি বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।
এছাড়া নবরংপুর, কালাহাণ্ডি, নয়াগড়, খুর্দা, পুরী, বোলাঙ্গির-সহ ১১টি জেলায় ‘অরেঞ্জ অ্যালার্ট’, এবং আরও ১৪টি জেলায় ‘ইয়েলো অ্যালার্ট’ জারি করা হয়েছে।
রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পূর্ব উপকূল ও দক্ষিণ-মধ্য রেলওয়ের শীর্ষ আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠক করে যাত্রীদের নিরাপত্তা, ট্রেন চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও দ্রুত পুনরুদ্ধারের নির্দেশ দিয়েছেন।
পরবর্তী গন্তব্য: তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ু ও পশ্চিমবঙ্গ
আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস অনুযায়ী, সাইক্লোন মন্থার প্রভাবে আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ু, ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গের কিছু অংশেও ভারি বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।
উপকূল থেকে ভেসে আসা হাহাকার এখন ছড়িয়ে পড়ছে স্থলভাগে, প্রকৃতির এই রুদ্ররূপে সতর্ক ভারতীয় উপকূলরেখা জুড়ে চলছে এক নিঃশব্দ লড়াই, মানবিকতা বনাম মহাপ্রকৃতির শক্তির।


