বঙ্গোপসাগরের উপর সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপ আরও ঘনীভূত হয়ে ‘ঘূর্ণিঝড় মন্থা’-য় পরিণত হয়েছে। ফলে অন্ধ্রপ্রদেশ, ওডিশা ও পশ্চিমবঙ্গে জারি হয়েছে উচ্চ সতর্কতা। তিন রাজ্যেই চলছে প্রশাসনিক প্রস্তুতি, উপকূলজুড়ে মোতায়েন ত্রাণ ও বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী।
কোথায় অবস্থান
ভারতীয় আবহাওয়া দফতরের (IMD) সর্বশেষ বুলেটিন অনুযায়ী, রবিবার ভোর ৫টা ৩০ মিনিট নাগাদ ঘূর্ণিঝড়টি দক্ষিণ-পশ্চিম ও সংলগ্ন দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগরের উপর অবস্থান করছিল 12.2° উত্তর অক্ষাংশ ও 85.3° পূর্ব দ্রাঘিমায়, অর্থাৎ চেন্নাই থেকে ৫৬০ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণ-পূর্বে, কাকিনাডা থেকে ৬২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ-পূর্বে এবং বিশাখাপত্তনম থেকে প্রায় ৬৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ-পূর্বে।
আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, আগামী ১২ ঘণ্টায় ঘূর্ণিঝড়টি উত্তর-পশ্চিমমুখী হয়ে আরও শক্তি সঞ্চয় করবে। পরবর্তী সময়ে এটি উত্তর-উত্তর-পশ্চিমমুখী হয়ে অন্ধ্র উপকূলের দিকে অগ্রসর হবে। ২৮ অক্টোবর সন্ধ্যা থেকে রাতের মধ্যে কাকিনাডা ও কালিঙ্গপত্তনমের মাঝামাঝি এলাকায় ঝড়ের স্থলাভিসার (landfall) ঘটতে পারে, সঙ্গে থাকবে প্রবল বর্ষণ, ঝোড়ো হাওয়া এবং উত্তাল সমুদ্র।
অন্ধ্রপ্রদেশে যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি Cyclone Mantha high alert
অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার ইতিমধ্যেই জারি করেছে পূর্ণাঙ্গ ‘সাইক্লোন অ্যাকশন প্ল্যান’। খাদ্যশস্য, জ্বালানি, প্যাডি সংগ্রহ, ও ত্রাণশিবির— সব ক্ষেত্রেই গৃহীত হয়েছে অগ্রিম ব্যবস্থা। রাজ্যের সিভিল সাপ্লাইস মন্ত্রী এন. মনোহর জানিয়েছেন, উপকূলবর্তী জেলাগুলিতে ৪০% রেশন মজুত সম্পন্ন হয়েছে; ২৬ অক্টোবরের মধ্যেই ফেয়ার প্রাইস শপে খাদ্য সরবরাহ শেষ হবে।
তেল, ডিজেল, এলপিজি এবং বিদ্যুৎ ব্যাকআপের জন্য জেলাশাসক ও তেল সংস্থাগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পূর্ণ মজুত রাখার। প্রায় ১,৫০০ ধানকল প্রস্তুত রাখা হয়েছে কৃষকদের সুবিধার জন্য। পাশাপাশি, ৫০ হাজারেরও বেশি ত্রিপল, দড়ি ও বালির বস্তা পাঠানো হয়েছে ফসল রক্ষার জন্য।
বিশাখাপত্তনম উপকূলে রিশিকোন্ডা ও সাগরনগর সমুদ্রসৈকত আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। পর্যটকদের দূরে থাকতে নির্দেশ দিয়েছে প্রশাসন।
ড. বি.আর. আম্বেদকর কোনাসীমা জেলার জেলাশাসক আর. মহেশ কুমার জানিয়েছেন, প্রায় ৬,০০০ পরিবারকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হবে ২৭ অক্টোবর সন্ধ্যার মধ্যেই। স্কুল-কলেজে ২৮ ও ২৯ অক্টোবর ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। ১২০ কিমি গতিবেগের ঝোড়ো হাওয়ার আশঙ্কা থাকায় বিদ্যুতের খুঁটি ও গাছ উপড়ে পড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। রাজ্যে মোতায়েন করা হয়েছে এনডিআরএফ দল, রাখা হয়েছে ক্রেন, গাছ কাটার যন্ত্র ও বিকল্প বিদ্যুৎ খুঁটি।
ওডিশায় ব্যাপক সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি
ওডিশা সরকার ইতিমধ্যেই ঝুঁকিপূর্ণ ও নিম্নাঞ্চল থেকে শুরু করেছে জনগণকে সরিয়ে নেওয়ার কাজ। রাজ্যের আটটি দক্ষিণ জেলা — মালকানগিরি, করাপুট, নবরংপুর, রায়গড়া, গজপতি, গঞ্জাম, কন্ধমাল ও কালাহান্ডিতে ১২৮টি বিপর্যয় মোকাবিলা দল মোতায়েন করা হয়েছে।
রাজস্ব ও বিপর্যয় ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী সুরেশ পুজারি জানিয়েছেন, সোমবার বিকেল ৫টার মধ্যে সমস্ত সরিয়ে নেওয়ার কাজ শেষ করা হবে। লক্ষ্য ‘জিরো ক্যাজুয়ালটি’। ২৪টি ওড্রাফ, পাঁচটি এনডিআরএফ ও ৯৯টি ফায়ার সার্ভিস দল প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
রাজ্যের সব বন্দরেই হাওয়া অফিস দিয়েছে “ডিস্ট্যান্ট কশনরি সিগন্যাল নং ১”। জেলেদের ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত সমুদ্রে না যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে ভারী বৃষ্টির সতর্কতা
পশ্চিমবঙ্গে ২৮ থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে ভারী বৃষ্টির দফায় দফায় সতর্কতা। যদিও স্থলাভিসার হবে অন্ধ্র উপকূলে, তবে দক্ষিণবঙ্গের একাধিক জেলায় প্রভাব পড়বে ঝড়ের।
আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, কলকাতা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, হাওড়া, ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও হুগলিতে ২৭ অক্টোবর থেকেই শুরু হবে বৃষ্টি। ২৮ থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান, বীরভূম ও মুর্শিদাবাদে।
উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং, কালিম্পং, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, উত্তর দিনাজপুর ও মালদহে ৩০ ও ৩১ অক্টোবর ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা।
সমুদ্র উত্তাল থাকবে, তাই জেলেদের ২৮ থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত সমুদ্রে না যাওয়ার নির্দেশ। যারা গভীর সমুদ্রে রয়েছেন, তাঁদের ২৭ অক্টোবরের মধ্যে ফিরে আসতে বলা হয়েছে।
‘মন্থা’র নজরদারিতে তিন রাজ্য
আইএমডি জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড় মন্থা এখন দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরের উপরে ১৫ কিমি প্রতি ঘণ্টা বেগে অগ্রসর হচ্ছে। এটি ২৮ অক্টোবর রাতে স্থলভাগে প্রবেশ করার আগে আরও শক্তিশালী হতে পারে। তিন রাজ্যেরই প্রশাসন জানিয়েছে, উপকূল এলাকায় নিরাপত্তা, ত্রাণ, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগব্যবস্থায় সর্বোচ্চ সতর্কতা বজায় রাখা হয়েছে।
“জনগণ ও মৎস্যজীবীরা এখনই সাবধান হোন। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঘূর্ণিঝড় আরও শক্তি সঞ্চয় করবে,” — জানিয়েছেন অন্ধ্রপ্রদেশ বিপর্যয় ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকাশ জৈন।


